আগেকার দিনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা নদীতে হ্যাচা জাল ফেলে মাছ ধরত। আর জালের মধ্যে মাছ তাড়িয়ে আনার কাজে ব্যবহার করত ভোঁদড়। ভোঁদড়কে কেউ বলে দাইড়েল। যে কারণে আমাদের দেশে কথার প্রচলন আছে দাড়ের দোয়ায় গাঙ্গ শুকাবে না। কিন্তু আজ সেই ভোঁদড় বিলুপ্ত প্রায়। তাইতো জেলে সম্প্রদায়সহ সাধারণ মানুষের মাঝে হারানো দিনের স্মৃতিসহ ভোঁদড়কে উজ্জীবিত রাখতে প্রতি বছর এইদিনে পালিত হয় বিশ্ব ভোঁদড় দিবস।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, একসময় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোতে জেলেরা হ্যাচা জাল দিয়ে মাছ ধরত। লম্বা দুইটি বাঁশের গোড়া একত্রে বেঁধে মাথা ছড়িয়ে রাখা হতো। বাঁশের গোড়ার দিকটা উঁচু করে নৌকার সাথে বেঁধে রেখে ভার বেঁধে রাখা হয়। ত্রিকোনা জাল বাঁশের সাথে বাঁধা হয়। এই জাল দিয়ে জেলেরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী মধুমতি, নবগঙ্গা, কপোতাক্ষ, চিত্রা, ভৈরব, আতাই, মজুদখালি, রূপসা প্রভৃতি নদীতে নৌকায় করে জেলেরা উল্লিখিত জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। নৌকার মাথায় একটি খাঁচায় বেঁধে রাখা হতো ভোঁদড় বা ধাইড়েল।
জেলেরা নদীতে জাল ফেলে ভোঁদড়ের গলায় দড়ি বেঁধে নদীতে ছেড়ে দিতেন। এবং ভোঁদড় মাছগুলিকে তাড়া করে জালে ঢোকাতেন। এবং জেলেরা জাল উঠিয়ে প্রাপ্ত মাছ হতে ভোঁদড়কে নাজরানা দিতেন।
খুলনার দিঘল দ্বীপ দিঘলিয়াসহ প্রায় সকল এলাকার নদ নদী খাল বিল জলাশয়গুলিতে দেখা মিলতো এই ভোঁদড়ের। মানুষের নির্মমতা ও অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ খাদ্য ও নিরাপদ বিচরণ ও বাসস্থানের সংকটের ফলে আজকে প্রকৃতি হতে এরা বিলুপ্ত।
পরিবেশ বিপর্যয়ে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে অনেক প্রাণী, কমে যাচ্ছে জেলেদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ভোঁদড়ের সংখ্যাও। একসময় কবিরা ভোঁদড়কে নিয়ে কবিতা বলতো-আয়রে আয় টিয়ে নায়ে ভরা দিয়ে, না নিয়ে গেলো বোয়াল মাছে তাইনা দেখে ভোঁদড় নাচে। উড়ে ভোদড় ফিরে চা খোকার নাচন দেখে যা। কবিরাও এখন আর ভোদড়কে নিয়ে কবিতা লিখে না। তবে আজও বাংলাদেশের বেশ কিছু জেলে পরিবার ভোদড় দিয়ে মাছ শিকারের শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। তারা ভোদড়কে মনে করে তাদের জীবিকার বন্ধু।
খুলনা হতে কয়েক কিলোমিটার দূরে নড়াইলের বেশ কিছু জেলে পরিবার আজও জালে মাছ তাড়িয়ে আনতে ভোদড়কে ব্যবহার করে। যদিও গত ২৫ বছরে ভোদড় দিয়ে মাছ শিকারি পরিবারের সংখ্যা ৫০০ থেকে ১৫০- এ নেমে এসেছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজের মতে এ হার চলমান থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ভোদড় দিয়ে মাছ শিকার শূণ্যে নেমে আসবে। এ ক্ষেত্রে জেলেদের কথা তাদের আয়ের অর্ধেকই ভোদড়ের খাবার কিনতে ব্যয় করতে হয়। এ ছাড়া নদীতেও এখন আর তেমন মাছ নেই। অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ আর দুষণের কারণে নদীতে মাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। তাই শুধু ভোদড় না, পেশাটিকেই ছাড়ার চিন্তা করছেন অনেক জেলে পরিবার।
প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বেই বদলে গেছে মাছ শিকারের ধরণ-ধারণ। যন্ত্রচালিত জাল ব্যবহার হচ্ছে সাগরে মাছ ধরতে। সেখানে দক্ষিণাঞ্চলের কিছু জেলে পরিবার এখনো ভোদড়কে তাদের পরিবারেরই একজন সদস্য মনে করে। জেলেরা তাদের জাল একের পর এক নদীর তীরবর্তী স্থানে পেতে রাখে। এরপর ছেড়ে দেওয়া হয় ভোদড়। জলাশয়ে চক্রকারে ঘুরে মাছ তাড়িয়ে জালে ঢুকায় এ প্রাণীটি। এজন্য ভোদড়কে অবশ্য অনেক প্রশিক্ষণ দিতে হয় বলে জানিয়েছেন ৫০ বছর বয়সী জেলে শসুধর বিশ্বাস।
যদিও এশিয়ার অন্যান্য জায়গায় অনেক আগেই ভোদড় দিয়ে মাছ শিকার পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এই অদ্ভূত পদ্ধতিটি শত বছর ধরে এ দেশে এখনো টিকে আছে। শসুধর বিশ্বাস বলেন, আমাদের জীবিকা মূলতঃ ভোদড়ের উপরই নির্ভরশীল। ভোঁদড় নিজের জন্য মাছ শিকার করে না। এগুলো মাছকে তাড়িয়ে নিয়ে নৌকার পাশে রাখা জালে নিয়ে আসে। আর এমনিতে যেখানে মাছের আকাল সেখানে ভোদড়ের সাহায্য না পেলেতো এ পেশা অনেক আগেই ছেড়ে দিতে হত।