আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে অপরাধীকে বাঁচাতে ধারালো অস্ত্রের আঘাত পরিবর্তন করে চিকিৎসা সনদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ৩ এপ্রিল রাতে ভুক্তভোগী কামরুল হোসাইন ও তার ভাই খাইরুল গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় নিজ বাড়ি ফেরার পথে ১৪ থেকে ১৫ জন সন্ত্রাসী তাদের পথরোধ করে চাইনিজ কুড়াল ও রাম দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ১১ লাখ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
এ সময় তাদের চিৎকারে প্রতিবেশী মুসা মিয়া, তার ছেলে স্বাধীন ও ইমন এগিয়ে এলে তাদেরও কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। পরে স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. লুবনা খানম আহত খাইরুল ইসলাম ও মুসা মিয়ার মাথায় প্রায় ৩০টা সেলাই করেন।
অন্যদিকে আহত কামরুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে রাজধানীতে রেফার্ড করেন। পরে কামরুলের স্বজনরা রাত পৌনে ১১টায় নরসিংদীর পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার হাতের মাংসের ভিতর ও বাইরের তিনটি স্তরে ২৮টি সেলাই করেন। হাসপাতালে আহতদের ভর্তি করেন। সেখানেই তিন ভুক্তভোগী দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেন।
প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে হামলা ও অর্থ ছিনতাইয়ের বিষয়ে পলাশ থানা তদন্ত করে গত ৪ এপ্রিল একটি মামলা রুজু করেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জানতে পারেন, কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্স থেকে তাদের আঘাতের যে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে সেখানে কোনো ধারালো অস্ত্রের আঘাতের উল্লেখ নেই। এমনকি শার্প কাটিং গিভিয়াসের স্থলে সবগুলো সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে ব¬ান্ট উইপন সিম্পল। যা তাদের শরীরের আঘাতের সাথে হাসপাতাল থেকে দেয়া জখমি সার্টিফিকেটের বাস্তব মিল নেই।
এদিকে আরও অভিযোগ উঠেছে, ঘটনার একদিন পর হামলাকারী করিম নামে একজনকে প্রাইভেট হাসপাতালের একটি এক্স-রে রিপোর্টের ভিত্তিতে ভর্তি দেখিয়ে হাত ভাঙার মিথ্যা গিভিয়াস সার্টিফিকেট দেন। ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই করিমকে সুস্থভাবে চলাফেরা করতে দেখেছেন বলে প্রতিবেদককে জানান।
অভিযোগ রয়েছে অর্থের বিনিময়ে এসব ভুয়া ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত মেডিকেল রিপোর্ট দিয়েছেন কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. লুবনা খানম, ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাক্তার অভিজিৎ দাস ও সহকারী সার্জন ডাক্তার শামীমা আছাদ। আর ওই অসঙ্গতি সার্টিফিকেট সংশোধনের আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি ও অশোভন আচরণের অভিযোগ উঠেছে কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর ই এলাহীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, তার পৃষ্ঠপোষকতায়ই অন্য চিকিৎসকরা এসব অপকর্ম করেছেন।
গত সোমবার এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেছেন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগের অনুলিপি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ও সির্ভিল সার্জন গাজীপুর বরাবরে পাঠানো হয়েছে।
ভুক্তভোগী কামরুল হোসাইন বলেন, কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সের ডাক্তার লুবনা খানম এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর ই এলাহী অপরাধীদের সাথে যোগসাজশে টাকার বিনিময়ে আঘাতের যথাযথ মেডিকেল সার্টিফিকেট দেননি। বরং অপরাধীকে বাচাতে মেডিকেল সার্টিফিকেটে ধারালো অস্ত্রের স্থলে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত দেখিয়ে সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন। যা আমাদের শরীরের আঘাতের সাথে সার্টিফিকেটের বাস্তবে কোন মিল নেই। চলতি মাসের ৮ তারিখ এই অসঙ্গতিপূর্ণ সার্টিফিকেট সংশোধনে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর ই এলাহীর দ্বারস্থ হলে তিনি শরীরের আঘাতের চিহ্ন, ওই সময়ের জখমের ছবি দেখে সার্টিফিকেট সংশোধনের আশ্বাস দিয়ে বলেন, প্রদানকৃত সার্টিফিকেটের মূলকপি নিয়ে এলে সংশোধন করে দেবেন। পরবর্তীতে কর্তব্যরত চিকিৎসক লুবনা খানমের সাথে কথা বলে তা সংশোধনে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
সার্টিফিকেটে অসঙ্গতি ও রেফার্ডের বিষয় জানতে ডা. লুবনা খানমের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় শুনে ফোনের লাইন কেটে দেন। এরপর চেষ্টা করেও তার নাম্বারে আর সংযোগ পাওয়া যায়নি।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর এলাহীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কামরুল হোসাইনের দুই হাতেই ইনজুরি ছিল। এক হাতের গিভিয়াস দেয়া হয়েছে। অন্য হাতের ক্ষত তেমন গুরুতর না থাকায় গিভিয়াস দেয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তিনি যে এক্স-রে রিপোর্টগুলো এনেছেন তা সঠিক ছিল না। সার্টিফিকেট প্রদানের পর তারা আপত্তি জানালে ছবি দেখে মনে করেছিলাম এটিও গিভিয়াস আসবে। পরে আমরা এ বিষয় নিয়ে টিম বসিয়ে দেখেছি কর্তব্যরত ডাক্তার যে সার্টিফিকেট দিয়েছেন তা সঠিক আছে। সার্টিফিকেটে কম-বেশি লেখার সুযোগ নেই। সার্টিফিকেটের মূল কপি আনতে বলা, লিখিত দিয়ে সার্টিফিকেট পরিবর্তন এমন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই এ কর্মকর্তা বলেন, মূল সার্টিফিকেট আনতে বলেছি সত্য। তবে অন্য যে অভিযোগগুলো করা হয়েছে তা সঠিক নয়।
যে ক্ষতস্থানে তিনস্তরে ২৮টি সেলাই দিতে হয়েছে সেখানে সার্টিফিকেটে কেন গিভিয়াস দেয়া যাবে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ২৮টি কেন ৭০টি সেলাই দিয়েও তিনি নাকি গিভিয়াস সার্টিফিকেট দেননি। শুধুমাত্র ৮টি ক্ষেত্র ছাড়া কোথাও নাকি গিভিয়াস দেয়া যায় না। তবে কোন ৮টি ক্ষেত্রে গিভিয়াস দেয়া যায় সেটাও ব্যাখ্যা করেননি।
প্রাথমিক অবস্থায় মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা পলাশ থানার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই সফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সে আহতদের দেখতে গিয়ে কামরুল হোসাইনের ডান হাতের জখম দেখেছি। জখমের ধরন দেখে মনে হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক জখম স্থানে সেলাই দিতে না পেরে তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করেছেন। পরে সেখানে না নিয়ে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. নিয়াজ মোর্শেদ হক অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে চিকিৎসা করতে গিয়ে দায়ভার তারা নেবেন না বলে জানান। তবে রোগীর স্বজনরা দায় নিয়ে লিখিত দিলে জখম স্থানে তিন স্তর বিশিষ্ট ২৮টি সেলাই করেন তিনি। এ ঘটনায় পলাশ থানায় মামলা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি নরসিংদীর ডিবিতে তদন্তনাধীন আছে বলেও জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
গাজীপুর সির্ভিল সার্জন ডা. মো. খায়রুজ্জামান বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিএমডিসিতে যদি ভুক্তভোগী অভিযোগ করে থাকেন তাহলে তারা আমাদের তদন্তের নির্দেশনা দেবেন। সেই আলোকে আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. মো. আরমান হোসেন বলেন, আজকেও (গত শনিবার) ডিসিপ্লি¬ন কমিটির মিটিংয়ে এ-সংক্রান্ত অনেকগুলো অভিযোগ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সের প্রধান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে আমরা অবশ্যই খতিয়ে দেখব।