বাংলাদেশের বস্ত্র খাতে বৃহত্তম তিনটি উপখাত স্পিনিং, উইভিং ও ড্রাইং-ফিনিশিং। এই উপখাতগুলোয় প্রায় ৫৫ লাখ কর্মকতা-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশের বৃহত্তর বিনিয়োগ এ খাতে, তাই এ খাতে যেমন সমস্যা তেমন সম্ভাবনাও প্রচুর। ডলারের উচ্চমূল্য, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণের অপ্রতুলতা, অর্থাভাব, উচ্চ সুদের হার, বিভিন্ন খাতে ঘুষ-দুর্নীতি, বাড়তি কর ভ্যাটের বোঝা আর গ্যাস বিদ্যুৎ সংকট, উচ্চমূল্যে বিপর্যস্ত এ খাতকে দেশের স্বার্থেই বাঁচানো দরকার। কোভিড পরিস্থিতিতে দেশের অনেক টেক্সটাইল, স্পিনিং বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণের দায়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে। যেগুলো কোনো মতে টিকে আছে সেসব শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বস্ত্র খাত সহায়ক বাজেট খুব-ই জরুরি।
দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সহযোগী শিল্প হিসেবে স্পিনিং, উইভিং ও ড্রাইং-ফিনিশিং এ তিনটি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে- যার কারণে তৈরি পোশাক শিল্প খাত ৭৬ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই এসব বস্ত্র খাত নিয়ে সরকারকে বেশি ভাবতে হবে। আজকের প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের বৃহত্তম শিল্প খাত তথা বস্ত্র খাত সম্পর্কে আগামী বাজেটে কী থাকা উচিত আর কী থাকা উচিত নয়, তা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
ইতোমধ্যেই আমরা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জেনেছি যেসব পণ্যের দাম কমবে তার মধ্যে রয়েছে বস্ত্র। এটা হলে বস্ত্র শিল্প টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই রুগ্ণ। বিশ্ব বাজারে টেক্সটাইল কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজের দাম বেড়েছে। বর্তমানে ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে কাঁচামাল আমদানি দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কোভিড পরিস্থিতিতে সব কিছু এখনো স্বভাবিক নয়- তাই উৎপাদিত পণ্য বিক্রি কমেছে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এর বড় প্রভাব পড়েছে। এ ধাক্কা সামাল দিতে বস্ত্র খাত কতটা কুলিয়ে উঠবে তা বোধগম্য নয়।
সবারই জানা দেশীয় টেক্সটাইল খাত ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র চলছে বহু বছর ধরে। সূক্ষ্ণ ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চালে আটকে যাচ্ছে এ শিল্প। গত কয়েক বছরে অসংখ্য টেক্সটাইল মিল (তাঁত) বন্ধ হয়ে গেছে। কোভিড কালীন ২০১৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত অসংখ্য টেক্সটাইল, স্পিনিং, গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। আমার নিজ এলাকা শিল্পসমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এ শিল্পের অনেকে লোকসান গুনতে গুনতে পথে বসেছেন। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে। এমন চিত্র সারাদেশের। সরকারি সুতা এবং বস্ত্রকল ধ্বংস হয়ে গেছে বহু আগেই। বেসরকারি সুতাকলগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো ছিল। বস্ত্র শিল্পের উৎপাদিত কাপড়ের দাম উৎপাদন খরচ থেকেও কমে যাওয়ায় লোকসান দিচ্ছে বস্ত্র কলগুলো। যার প্রচন্ড প্রভাব পড়েছে ডাইং প্রিন্টিং শিল্পে। বস্ত্র (তাঁত) এবং ডাইং শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় স্পিনিং (সুতা কল) শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সুতা কলগুলোও। যেগুলো চলছে তা চলছে অনেকটাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
এদিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মিল মালিকরা এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যস্ত। বেশি দামে আমদানিকৃত তুলা দিয়ে সুতা ও কাপড় তৈরি করে মিল মালিকরা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। ক্রেতার অভাবে তাদের গুদামে দীর্ঘদিন ধরে জমে আছে লাখ লাখ টন সুতা। এভাবে মাসের পর মাস লোকসান দিয়ে এবং ব্যাংকের ঋণ ও সুদ গুনতে গিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক স্পিনিং ও টেক্সটাইল মিল। আর দেশীয় সুতা ও বস্ত্র কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তৈরি পোশাক শিল্পেও পড়তে শুরু করেছে নেতিবাচক প্রভাব।
দেশের বস্ত্র ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবি, তারা ঘুষসহ নানাভাবে ৪০ শতাংশ রাজস্ব দিচ্ছে সরকারকে। এ হারে রাজস্ব দিয়ে শিল্পায়ন হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাজেট উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সহিদুলস্নাহ আনসারী। সেদিন জাতীয় কবি নজরুল জয়ন্তীতে অতিথি হয়ে যোগ দিতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের ত্রিশালে যাচ্ছিলাম আমরা। বাজেট বিষয়ে তার সঙ্গে অনেক কথা হলো। তিনি বলেন, বস্ত্র খাত টিকিয়ে রাখতে সরকারের কড়া দৃষ্টি রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষ এ বাজেটে কর ভেট কিছুটা কমতে পারে বলে তিনি বললেন। গত ৩০ বছর ধরে দেশের বৃহত বস্ত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান এখলাস গ্রম্নপের নির্বাহী পরিচালকের দ্বায়িত্ব পালন করে আসছি। সে আলোকে বলতে চাই, কর ভেটের আওতা কমানো, গ্যাস বিদ্যুৎ সহজ লভ্য করা, ব্যাংক ঋণপ্রাপ্তি সহজ করা, ঘুষ দুর্নীতি বন্ধ না হলে বস্ত্র খাত খাদের কিনারে পড়বে।
অনেক শিল্প মালিক বলেছেন, দেশের মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মূল্য সংযোজন কর মূসক বা ভ্যাট দেন। বাকি ৯০ শতাংশ দেন না। তাই পরিধি বাড়িয়ে ভ্যাটের হার কমিয়ে সারাদেশ থেকে ভ্যাট আদায়ে ব্যবসায়ীরা প্রস্তাব করেন। ভ্যাটের হার নয় পরিধি বাড়ানোর ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত মনে হয়। হাল সালের তথ্য মতে, দেশে ভ্যাট নিবন্ধন আছে ১০ লাখ ৪০ হাজারের মতো। কিন্তু সম্ভবত মাত্র ৪৫ হাজার ব্যবসায়ী ভ্যাট দেন। এটা খুব কম। এটাকে বাড়াতে হবে। এদিকে ভ্যাট আইন নিয়ে ভীতিতে আছেন ব্যবসায়ীরা। এরইমধ্যে রাজস্ব কর্মকর্তাদের কাছ থেকে হয়রানির হুমকি পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। অবশ্যই এ ব্যাপারে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, যে কোনো অভিযোগ সরাসরি তার দপ্তরে জানাতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। রাজস্ব বোর্ডের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এসব কথা উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে বাজেট উপদেষ্টা ড. শহীদুলস্নাহ সরি বলেন, দেশের শিল্প খাত বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি আমরা সে লক্ষ্যে বাজেটে এ খাতের সহায়ক বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। আমরা যতদূর জেনেছি, জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে নতুন ভ্যাট আইন আরও কঠিন হবে। যারা ভ্যাটের আওতায় নেই তাদের সবাইকে ভ্যাটের আওতায় আনা হবে। এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে রাজস্ব বোর্ড ও অর্থমন্ত্রণালয়। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, নতুন পদ্ধতিতে ভ্যাট দেয়া কিংবা হিসাব নিকাশ করার মতো সামর্থ্য ও প্রস্তুতি ছোট ব্যবসায়ীদের নেই। এমনিতেই তারা প্রতিষ্ঠান চালাতে পারছে না আবার এ খাতের নতুন লোক নিয়োগ দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানই। ছোট এবং মাঝারি শিল্পগুলো এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বস্ত্র শিল্পের যা অবস্থা তাতে ছোটখাটো বস্ত্র শিল্পই বেশি সমস্যায় পড়বে। ভ্যাট আয়কর আর মূসকের চাপে তারা এখন ব্যবসাই টিকিয়ে রাখতে পারছেন না- তার ওপর দক্ষ জনবল বাড়ানো তাদের জন্য কষ্ট সাধ্য হবে। বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আনা উচিত বলে মনে করি।
বস্ত্র শিল্পকে বাঁচাতে ২০২২-২৩ সালের বাজেটে বস্ত্র খাতের ওপর বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার স্বার্থে কর অবকাশ সুবিধা আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত করা অত্যাবশ্যক। গেস্নাবালাইজেশন, সুতার মূল্যবৃদ্ধি, ইউ রুলস অব অরিজিনসহ অন্যান্য কারণে সৃষ্ট অসম প্রতিযোগিতা মোকাবিলার মাধ্যমে ওভেন উপখাতকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিকল্প নগদ সহায়তা ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ন্যূনতম ১৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা আগামী ২০২৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে বিটিএমএ। এর ফলে বস্ত্র খাত উপকৃত হয়ে অর্থনীতিতে আরও অবদান রাখতে সক্ষম হবে মনে করছে সংগঠনটি। এটি তাদের যৌক্তিক দাবিও। বস্ত্র শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, সাইজিং ম্যাটেরিয়েল, রাসায়নিক দ্রব্যে শুল্ক ও কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা দরকার। বর্তমানে বিদ্যমান শতাংশ আমদানি শুল্ক উদ্যোক্তাদের আর্থিক বোঝা লাঘবের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না। তাই বস্ত্র শিল্পে বিনিয়োগ উৎসাহিত ও প্রকল্প ব্যয় হ্রাসকরণের স্বার্থে আগের মতো বস্ত্র খাতে ব্যবহৃত যাবতীয় ক্যাপিটাল মেশিনারিকে শূন্য শুল্কে আমদানির সুবিধা দেয়া প্রয়োজন।
স্পিনিং শিল্পের জন্য দেশে বর্তমানে চার মিলিয়ন বেলের বেশি তুলা আমদানি করা হয়। মিল কর্তৃক তুলা আমদানি হলে কোনো ধরনের শুল্ক ও কর দিতে হয় না। কিন্তু দেশের বাজার থেকে অন্য কোনো মাধ্যম থেকে তুলা কিনলে প্রতি পাউন্ডে ২ দশমিক ২৫ টাকা হারে ভ্যাট দিতে হয়। ফলে সুতার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজেটে এই ভ্যাট প্রত্যাহার করা জরুরি। বর্তমানে বস্ত্র কারখানায় ব্যবহার অযোগ্য তুলা- যা বর্জ্য হিসেবে পরিচিত, তা মিল থেকে অপসারণ করতে প্রতি কেজিতে এক থেকে ১০ টাকা হারে ভ্যাট দিতে হয়। যদিও এই বর্জ্য তুলা কোনো উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে না; বরং বিদ্যমান আইনে বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা, অনিয়ম ও হয়রানির সৃষ্টি হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় আগামী বাজেটে বর্জ্য তুলা অপসারণে ভ্যাট প্রত্যাহার করা দরকার।
দেশের বস্ত্র খাতে বিদ্যমান সংকট সমাধানের উপায় হচ্ছে, স্পিনিং মিলগুলোর জন্য অন্তত ২০ শতাংশ হারে ক্যাশ ইনসেনটিভ প্রদান ও গোটা বস্ত্র খাতের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ শতাংশে নিয়ে আসা। ডাইং শিল্পের জন্য সরকারিভাবে (যৌথ) ইটিপি স্থাপন করা, দেশীয় সুতা ও কাপড় প্রস্তকারকদের ১৫-২০ শতাংশ হারে ক্যাশ ইনসেনটিভ দেয়া। এ ছাড়া বাহিরের বস্ত্র এবং সুতা আমদানিতে যথাযথ তদারকি করা। বস্ত্র শিল্পকে বাঁচাতে হলে এই উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকটেরও সমাধান করা জরুরি। আমাদের শিল্প সংরক্ষণ নীতি গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-আগ্রাসনও প্রতিরোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব না দিলে দেশের বস্ত্র শিল্প বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হবে।
(মীর আবদুল আলীম : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক)