আচ্ছা বলতো তুমি এত রাতে কিভাবে আসলে? তোমার একটুও ভয় করলো না ? যদি কেও দেখে ফেলে তোমাকে আমার ঘরে ? আমার কিন্তু অনেক ভয় করছে।
- এখন বাজে প্রায় রাত ২ টা। কে দেখবে বলো ? কতদিন ধরে এই রাত টার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম তা কি তুমি জাননা? পুরো ৫ দিন। তোমার বাবা মা অবশেষে রাতুল কে নিয়ে ঢাকা স্কুল এ ভর্তি করতে গেলেন।
- হ্যা তুমিই তো রাজি করিয়েছো বাবাকে। তাছাড়া তোমার বাবা যদি ওই টাকা গুলো ধার হিসেবে না দিতেন রাতুল কে বাবা কোনদিন ঢাকাতে ভর্তি করাতে পারতেন না।
- আচ্ছা বাদ দাওতো এসব কথা। এইযে আমরা দুজন এত কাছাকাছি তোমার ভাললাগছে না ?
হঠাত অনেক লজ্জা পেয়ে গেলো নাবিলা। লাজুক কন্ঠে বলল
-হ্যা অনেক ভাললাগছে।
মাথা নিচু করে আছে নাবিলা। তাকাতে পারছে না জাফর এর চোখের দিকে।
-আচ্ছা নাবিলা তোমার চোখের পাপড়ি গুলো এত বড় বড় কেনো? ঠিক গরুর মত লাগে দেখতে।
- কি বললে তুমি ? দাড়াও দেখাচ্ছি মজা তোমাকে।
নাবিলা দু হাত দিয়ে জাফর এর চুল ধরে একটু জোরে ঝাকাতে লাগলো।
- উফ ছাড়ো ব্যাথা পাচ্ছি।
- না ছাড়বোনা।
- ছাড়বে না ?
- নাহ।
- আচ্ছা ধরে রাখো, কিন্তু আলতো করে।
কথাটা অনেক আবেগ নিয়ে বললো জাফর। নাবিলার হাত কেঁপে উঠলো। আর শক্ত করে ধরতে পারছে না। হাত সরাতেও পারছে না। আর তখনি জাফর তার দুহাত নাবিলার দুই গালে রেখে বললো -
-তোমার ওই বড় বড় চোখ গুলো আমার। শুধু আমার।
নাবিলা কোন কথা বলল না। জাফর ও না। দুজন দুজন কে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো।
- আচ্ছা নাবিলা আমি যাই তাহলে। কাল আবার আসবো রাতে। তোমার বাবা মা তো কালও ফিরতে পারবে না।
- এভাবে খালি বাসা পেয়ে তুমি আসছো এত রাতে এটা কি ঠিক হচ্ছে ?
- তুমি আমাকে ভালবাসো তো ? যদি বেসে থাকো তাহলে কোন পাপ নেই মনে রেখো।
- বাসিতো, অনেক বেশী ভালবাসি তোমাকে। তুমি আমাকে প্রমিজ করো কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবেনা।
-তোমাকে ছেড়ে যাবো সেদিন, যেদিন আমার আত্মা আমার দেহ কে ছেড়ে যাবে।
- জাফর ! এত ভালবাসো আমাকে ?
- তার চেয়েও বেশী ভালবাসি।
- আচ্ছা এবার তুমি যাও। ভোর হয়ে গেছে। কেও দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
আর তখনি দরজায় করা নাড়লো কেও। নাবিলা আর জাফর ছিটকে পড়লো। ভয়ে নাবিলা কাঁপতে লাগলো। জাফর ও থমকে দাঁড়িয়ে আছে। কেও কোন কথা বলছে না।
আবার করা নাড়ার শব্দ, সাথে কেও ডাকছে।
-নাবিলা ! নাবিলা ! দড়জা খোল। এইসব কি করতাছস ? লজ্জা সরমের মাথা কি খাইয়া ফালাইছস?
খোল কইতাছি। তর বাপ মায় বাড়িত নাই আর তুই এইখানে রং তামাসা শুরু করছস ?
এবার আরেকজনের কন্ঠ ভেশে আসল।
- ওই হারামজাদী, মুখ পুড়ী, অহনো বাইর হছ না? ঘরের মদ্যে কারে লইয়া বাসর জমাইছস?
একজন মহিলার আওয়াজ ভেশে আসলো। নাম মরিয়ম। বয়স পঁয়তাল্লিশ এর মত হবে। তিন বার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোন সংসার টেকেনি। কেও জানে না কেন টেকেনি। কোন সন্তানও হয়নি তার কোন সংসারে। সে বলে উঠলো -
- অই মাগীর ঘরের মাগী বাইর হ নইলে দরজা ভাইঙ্গা কেমনে বাইর করি তরে দেখ। সারাদিন এই পাড়া ওই পাড়া ঘুইরা তোর মন বরে না এহন তুই রাইতের বেলাও নষ্টামি শুরু করছস ?
নাবিলা আর জাফর বুঝতে পারছে না কি করবে। দুজনি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। করা নাড়ার শব্দ বেড়েই যাচ্ছে। বাহির থেকে হই চই আর গালাগালি বেড়েই যাচ্ছে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল দরজা খুলে দেবে। কিন্তু দরজা খোলার পর কি হবে সেটা ভেবে অনেক ভয় পাচ্ছে নাবিলা।
- জাফর তুমি পেছনের দরজা দিয়ে চলে যাও। আমার যা হয় হোক কিন্তু তোমাকে হয়ত অনেক মারবে ওরা। আমি সহ্য করতে পারবনা। প্লিজ তুমি যাও।
- আর তোমাকে বুঝি ওরা কিচ্ছু বলবে না ? আমি যাবনা।
- প্লিজ আমার কথা শোনো। প্লিজ প্লিজ তুমি যাও।
নাবিলা টেনে জাফর কে পেছনের দরজার কাছে নিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই দুজন ভয়ে থমকে গেলো। পাড়ার সব মানুষ পেছনের দরজার সামনে চলে এসেছে। পাশের বাড়ির জমির চাচা জাফর এর দিকে এগিয়ে এসে বলল -
- আইচ্ছা, তাইলে রমিজ এর পোলা জাফর ? ওই পোলা, তুই জানস না তুই কোন বংশের পোলা ? মাইঝ রাইতে গরীব মাইয়াডার ইজ্জৎ লইয়া কেন খেলতাছস ?
জাফর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর নাবিলা ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে আছে। চোখ ভিজে একাকার হচ্ছে।
ওমনি আলতাফ চাচা জমির চাচা কে হাত দিয়ে একটু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। আর বলে উঠলো -
- আরে রাখেন আপনের বংশ পরিচয়। কোন বড়লোক এর বাচ্চা এই পোলা এইডা আমগো দেহার বিষয় না। এই পোলা আমগো পাড়ায় আইসা আমগো মাইয়ার ইজ্জৎ এর উপর হাত দিছে। উড়ে ধইরা পায়ে থাইকা মাথা পর্যন্ত পিডাইলে ওর আক্কেল ওইবো।
মরিয়ম খালা বলে উঠলো -
- আরে পোলাডারে দোষ দিয়া লাভ কি ? আমগো মাইয়াডা কি দুধে ধোয়া তুলসী পাতা ? আমি উড়ে হাড়ে হাড়ে চিনি। শহরে গিয়া কি করে না করে। দুই দিন পর পর ইস্টাইল করা বান্ধবী গো লইয়া এইহানে ওইহানে যায়।
নাবিলা টাংগাইল শহরের একটা গার্লস স্কুলে পরে। বাড়ি থেকে একটু দূরে টাঙ্গাইল শহর। ওদের বাড়িটা শহরে বাইরে। এখনও গ্রামের ছোঁয়া পুরোপুরি আছে।
ওদের বাড়ির ঠিক পাশ দিয়েই একটি সরু রাস্তা গিয়েছে। সেই সরু রাতা ধরে হাটতে অনেক ভাললাগে নাবিলার। শহরের স্কুল এর বান্ধবীদের এই রাস্তা টা খুব পছন্দের আর তাই ওর দুই বান্ধবী চারু আর দিশা মাঝে মাঝেই নাবিলাদের বাড়ি আসে আর সবাই মিলে ওই সরু পথে হাটতে যায়।
আর ওই পথেই জাফর সাইকেল নিয়ে কলেজ এ যেত। মাঝে মাঝে বন্ধুদের নিয়ে ঘোরাঘুরি ও করতো।
ছোট বেলা থেকেই নাবিলা জাফর কে চিনত। কিন্তু জাফর কখনও খেয়াল করেনি নাবিলাকে। নাবিলা মনে মনে জাফরকে ছোটো থেকেই পছন্দ করতো।
একদিন নাবিলা বাড়ির পাশে সেই রাস্তা ঘেঁষে বসে ছিলো। রাস্তার অপর পাশে পানি আর পানি। অনেক লম্বা বিল বয়ে গেছে রাস্তা ধরে। যত দূর এই সুন্দর পিচ ঢালা রাস্তা তার চেয়েও লম্বা।
সেদিন বসে বসে নাবিলা খুব কাঁদছিল। আর জাফর সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। নাবিলার কাছাকাছি আসতেই হঠাত সাইকেল এর চেইন পড়ে গেলো। জাফর সাইকেল থেকে নেমেই চেইন ঠিক করতে যখন ঝুঁকে গেলো আর তখনি তার চোখ পরলো নাবিলার উপর। মেয়েটির মাথা সবুজ একটি ওড়না দিয়ে ঢাকা। বিলের দিকে মুখ করে বসে আছে আর খুব মৃদু স্বরে কাঁদছে।
জাফর সাইকেল রেখে এগিয়ে গেলো।
- এইজে আপা, কাঁদছেন কেনো ?
নাবিলার কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু মাথা ঘোরালো না। জাফর দেখতে পারছে না নাবিলাকে। আবার বলে উঠল -
- কি হইছে আপনের ? কথা বলেন না কেন ?
নাবিলা তখনো চুপ। আরো জড়সড় হয়ে বসলো।
- আইচ্ছা কান্দেন। আমি গেলাম।
বলে সাইকেল এর চেইন ঠিক করে চলে গেলো জাফর। সাথে সাথে নাবিলা ঘুরে তাকালো। আর তখন দেখলো এটা আর কেও নয়। পশ্চিম পাড়ার রমিজ চাচার ছেলে জাফর। যাকে সে দেখার জন্য বাড়ির পাশে লুকিয়ে থাকে। কখন সে সাইকেল নিয়ে যাবে এই পথ ধরে কখন সে জাফর কে এক ঝলক দেখবে। কিন্তু এই সময় কখনো সে জাফর কে যেতে দেখেনি তাই ভাবতেও পারেনি জাফর ওকে পেছন থেকে ডাকছে।
পরের দিন আবার যাচ্ছিল জাফর কলেজের উদ্দেশে। জাফরের মনে পরে গেলো গতকালের কথা। নাবিলার বাড়ির কাছে এসে থেমে গেলো। না এবার সাইকেল এর চেইন পরে নি। ইচ্ছে করেই থামলো। যেখানে নাবিলা বসে ছিলো ওই জায়গায় এগিয়ে গিয়ে দেখলো আজো মেয়েটি আছে কিনা। কিন্তু না, নাবিলা ছিলনা ওখানে কিন্তু দূর থেকে লুকিয়ে ঠিকি দেখতে পেলো জাফর কে। আর ভাবছিলো-
- আচ্ছা সে কি আমাকে খুজছে ? নাকি এমনি সাইকেল থামিয়েছে। যদি সত্যি সে আমাকে খোঁজে ? আমি কি যাব ?
নাহ থাক।
জাফর চলে গেলো। এভাবে প্রতিদিন জাফর নাবিলার বাড়ির কাছে এসে সাইকেল থামিয়ে দিতো। কখনো এক মিনিট কখনো দুই মিনিট। তারপর চলে যেত। আর নাবিলা প্রতিদিন ওকে এভাবে দেখতো।
একদিন বিকেলে নাবিলার বান্ধবী চারু এসেছে। দুজনে হাটছিলো ওই পথে। চারু সব জানে জাফর এর ব্যাপারে। দুজন জাফর কে নিয়েই গল্প করছিলো। আজো নাবিলা সেই সবুজ রঙের ওড়না পরেছে। যে ওড়না সেইদিন পরেছিল যেদিন জাফর এসে পেছন থেকে ডেকেছিলো।
জাফর যাচ্ছিলো সাইকেল নিয়ে। তার সাইকেল এর পেছনে এক বন্ধু বসেছে। বন্ধুর নাম তারেক। তারেক নাবিলাদের বাড়ির পেছনের বাড়ির ছেলে। অনেক বেশী পাকনা ছেলেটা। নাবিলা ওর সাথে কথা বলে না। জমির চাঁচার ছেলে হলেও বাবার মত ভাল হয় নি। এটাই নাবিলার ধারনা।
হাঁটতে হাঁটতে যখন অনেক দূর চলে গেলো নাবিলা আর চারু তখনি জাফর আর তারেক সাইকেল নিয়ে উল্টো দিক থেকে আসছিলো। জাফর দূর থেকেই খেয়াল করছিলো সেই সবুজ ওড়না। এখনও মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা। জাফর কাছাকাছি এসেই সাইকেল থামিয়ে দিলো। আচমকা সাইকেল থামানোর কারণে নাবিলা আর চারু চমকে উঠলো। সাইকেল থেকে নেমে জাফর নাবিলার দিকে তাকালো। নাবিলার চোখের দিকে তাকিয়ে জাফর স্তব্ধ হয়ে গেলো।
- এ কেমন চোখ ? এত মায়া ? এত বড় বড় চোখের পাপড়ি সে আগে কখনো দেখেনি। সেদিন এই চোখ দিয়েই জল পরছিলো ?
এসব ভাবতে ভাবতে কখন নাবিলা আর চারু পাশ কেটে চলে গেলো টের পেলোনা জাফর। তারেক বলে উঠলো -
-দোস্ত চল। পাখি উড়াল দিছে।
জাফর কোন কিছু না বলে সাইকেল এ উঠে বসলো। তারেক ও পেছনে উঠে বসলো আর বক বক করতে থাকলো। কিন্তু জাফর কিচ্ছু শুনছেনা। ও সাইকেল চালাচ্ছে আর চালাচ্ছে। জাফর সাইকেল চালাচ্ছে আর ওর মনের ব্যাকগ্রাউন্ড এ মিউজিক বেজে চলছে ৃৃৃৃৃৃৃৃ..
কি দারুণ দেখতে,
টানা টানা চোখ দুটো,
যেন শুধু বলে কাছে আসতে,
এই ভেজা ভেজা ঠোঁট দুটো
বলে, ভালবাসতে’ ”
(বাংলা সিনেমার গান )।