ঘুষ কি? মানুষ এত এত খাওয়ার উপাদেয় সব খাদ্য থাকতে ঘুষ খেতে যায় কেন? ঘুষ বাণিজ্যের প্রভাব ঠিক কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে আমাদের ওপর? এসব প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনার আগে ঘুষ বিষয়ক একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। এক বড় পদের কর্মকর্তা গিয়েছেন কোন এক দাওয়াতে। সেখানে বহু পদের খাবার থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনটাই তৃপ্তি করে খেতে পারছেন না। কারণ ডায়াবেটিস,হাই ব্লাড প্রেসার এসব আভিজাতিক রোগে বেচারা ভারাক্রান্ত। তো অতিথিকে রুচি সম্পন্নভাবে খেতে না দেখে বাড়ির কর্তা জানতে চাইলেন তিনি তাহলে কি খান? বেচারা কোন জবাব না দিলেও পাশ থেকে ঠিকই কেউ বলে উঠলেন উনি তো কেবল ঘুষই খান! যে এই সত্য বাক্য উচ্চারণ করেছিল তার ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা আমি জানি না। কিন্তু অনেকেই আছেন সত্যিকার অর্থেই তেমন কিছুই খেতে পারেন না। কেবল ওই ঘুষটাই খান। এবার আসি ঘুষ কি। ঘুষ হলো পরিশ্রমের প্রাপ্যর বাইরের সেই আয় যা আমরা অনৈতিকভাবে উপার্জন করি আরও একটু সুখে থাকার আশায়! তবে সেই সুখ মেলে কি। অনেক সময় আইনের তাড়া খেয়ে অনেককে মান সম্মান খুঁইয়ে রাস্তায় বসতে দেখেছি। অনেককেই দেখি সারা জীবন মানুষের কাছ থেকে হাত পেতে ভিক্ষা নেয়া ঘুষের টাকা শেষ জীবনে তার ওপরই বোঝা হয়ে চেপে বসেছে। ঘুষকে আমি ভিক্ষার থেকেও নিকৃষ্ট মনে করি। তবে অনেক কিছুই সয়ে যায়। এই যেমন ঘুষ বিষয়টিকে অনেকের কাছেই খারাপ লাগে বলে মনে হয় না। একটু আগে কাজ করাতে, একটু অবৈধ সুবিধা নিতে বা দিতে স্বেচ্ছায়ও ঘুষ দিয়ে আসেন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্ট্যাডিজ-সিজিএস এবং সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট এন্টারপ্রাইজ-সিআইপির পরিবারভিত্তিক এক জরিপে উঠে আসা তথ্যে দেখা যায়, দুর্নীতি সম্পর্কে নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি,মনোভাব,বিশ^াস মিশ্র। সংস্থাটি বলছে, বর্তমান দুর্নীতির পর্যায় অগ্রহণযোগ্য মনে করছে ৪৪ শতাংশ উত্তরদাতা। দুই তৃতীয়াংশের বেশি কিছু উত্তরদাতার মতে, অনুমোদনহীন সেবা, অর্থ উপহার, অথবা ঘুষ কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ উল্লেখ করেছে যে, এটা সর্বদা বা মাঝেমধ্যে সমর্থনযোগ্য। ভাবা যায়! অর্থাৎ বিষয়টা আমরা ধারণ করতে শিখে গেছি! দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বদলে সহ্য করা। কারণ যে ভিক্ষুক সে সরাসরি মানুষের কাছ থেকে হাত পেতে তার দয়া চেয়ে তারপর ভিক্ষা নেয়। আর ঘুষখোর তো রীতিমতো কাউকে জীম্মি করে তারপর অতিরিক্ত টাকা আদায় করে ছাড়ে। ফলে এটা আরও বেশি অপরাধ এবং অসম্মানের। যে ভিক্ষুক তার ভেতর হয়তো কোন শিক্ষার আলো নেই কিন্তু যে ঘুষ নেয় তাদের অধিকাংশরই কিন্তু শিক্ষা রয়েছে এবং তারা রীতিমতো দামী দামী চেয়ারে বসে সেই ভিক্ষার টাকা গ্রহণ করছে।
ঘুষখোর শব্দটি একটু নেশাখোর শব্দের সাথে বেশ মিলে যায়। মাদকের যেমন নেশা হয় ঘুষেরও নেশা হয়। ঘুষের নেশা হলো টাকার নেশা। মাদকের নেশার থেকেও তা ভয়ংকর। মাদকের নেশা অনেকসময় মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে ছাড়িয়ে আনা যায় কিন্তু ঘুষের নেশা কেউ ছাড়তে পেরেছে বলে শুনিনি। অন্তত আমার জানা নেই। আমার শোনা একটা সত্যি ঘটনা বলি। এক পরিচিতজন গল্পে গল্পে তার কোন এক বড় কর্মকর্তা আতœীয়র কথা বলছিলেন। তিনি নাকি চাকরির মাত্র কয়েক বছরেই বাড়ি গাড়ির মালিক হয়ে গেছেন। তিনি নাকি বেতনের বাইরে বেশ মোটা আয় করে থাকেন। এই আয় সম্পর্কে জিজ্ঞ্যেস করায় তিনি নাকি তাকে বলেছিলেন এটা তিনি পেয়ে থাকেন। মানে তার প্রাপ্য। এই পেয়ে থাকি কথাটা আজকাল বেশ সস্তা হয়ে গেছে। আপনি যেখানেই যান যে কাজেই যান দেখবেন এই পেয়ে থাকি কর্তাদের দৌরাত্ব। এদের এই পেয়ে থাকির দাপটে আমাদের সাধারণ মানুষের প্রাণ যেয়ে থাকি অবস্থা। বেতন দ্বীগুণ করার পর ভেবেছিল এবার বুঝি ক্ষুধাটা মিটবে। কিন্তু কিসের কি আরও বেশি গতিতে এসব উপরি পাওনার হিসাব চলছে। আসলে মানুষ কি ঘুষ অভাবে খায়। আমার কাছে মনে হয় মানুষ ঘুষ অভাবে খায় না. খায় স্বভাবে। ঐ যে বললাম অভ্যাস। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে লজ্জা ভেঙে গেলেই হলো। হাত পাততে আর লজ্জা লাগে না। তাই বেতন বাড়ার পরেও অনৈতিক আয়ের চর্চা দেশ থেকে উঠে যায় নি। যারা দিন রাত ঘুষের টাকার জন্য হাত পেতে থাকতো তারা তাদেও হাত গুটিয়ে নেয়নি। বরং হাতটাকে আরও একটু লম্বা করেছে যাতে আরও বেশি আয় হয় চাইলেই বা একটু চাপ দিলেই যদি বেশি পাওয়া যায় তাহলে হাত লম্বা না করেই বা কি হবে। সেই রাশিয়ান গল্পের কথা মনে হয়। শয়তান মানুষের বেশে লোভী মানুষটিকে বলেছিল সারাদিনে যতদুর দৌড়াতে পারবে ততদুর পর্যন্ত তোমার জমি। শেষপর্যন্ত লোভী মানুষটি বহুদূর দৌড়েছিল কিন্ত জমি নিতে পারেনি। মারা গিয়েছেল। আসলে সাড়ে তিনহাত জমিই তো মানুষের দরকার। এর থেকে আড়ম্বও কওে কোন লাভই নেই।
সকালে আজকাল অনেকেই দুই পিস রুটিই খান। কেউ কেউ আবার তেমন কিছুই খান না। কিন্তু অফিসে বসে ঘুষের টাকা কিন্তু ঠিকই হজম করে দেন। এমনিতে অন্য টাকার সাথে ঘুষের টাকার কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল আয়ের মাধ্যমের ভিন্নতায়। ঘুষ মানেই দুর্নীতি। আর এই ঘুষ বাণিজ্য আজ একেবারে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার কওে আছে। অনেকদিন আগে পত্রিকায় দেখেছিলাম ভারতে এক অফিসে ঘুষ চাওয়ার কারণে সেই অফিসে সাপ ছেড়ে দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী। ঘুষের টাকা না পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন সব কাগজপত্র ঠিকা থাকা সত্ত্বেও ফাইল আটকে থাকে। অপরদিকে উপরি দেয়ার জন্য অনেক কাগজপত্র ঠিক না থাকা ফাইল বুলেট ট্রেনের গতিতে টেবিল ছাড়া হয়ে যায়। ঘুষের কি ক্ষমতা! ক্ষমতা তো অবশ্যই। যারা ক্ষমতা আছে সেই তো ঘুষ-টুষ খায়! ঘুষ খেতেও তো সাহসের দরকার হয়। তবে সেটা সৎ সাহস না অসৎ সাহস তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের চোখের সামনেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া ঘুষখোর ব্যক্তির দেখা মেলে। আমরা বিষয়টা নিয়ে সমালোচনা করলেও প্রকাশ্যে কিন্তু তা বলা হয় না। কারণ ঐ যে ক্ষমতা। তিনি আবার বেশ ক্ষমতাশালীও হন। তাছাড়া ঘুষ লেনদেনের বিষয়টা যেন আজকাল সিস্টেমে পরিণত হয়ে গেছে। সবাই বুঝে গেছে উপরি না দিলে তার কাজ হয় হবে না আর না হলে অনেক দেরীতে হবে। সেই ভয়ে আগেভাগেই ঘুষ দিয়ে পকেট মোটা করেন।
এটা পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়ে গেছে যে না পেলেই মনে হয় তার পাওনাটা কেউ দেয়নি। চাকরিপ্রার্থীকে চাকরি পেতে হলে যে মামার জোর থাকতে হয় তা আজ ওপেন সিক্রেট। অর্থ সক্ষমতা না থাকার জন্য কত মেধাবী তার যোগ্যতা দেখানো সুযোগ পাননি তার হিসাব কে রাখে। যার মামা নামক টাকা আর আতœীয় স্বজনের জোর আছে তাকে কোন না কোনভাবে ঠিক চেয়ারে নিয়ে বসান। এই উপরি না দেয়ার কারণে মেধার মূল্যায়নটা আমাদের দেশে ঠিকমত হচ্ছে না। সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে, দেশের প্রান্তিক মানুষকে উন্নয়নের স্বাদ দিতে হলে এই ঘুষ বাণিজ্যের লাগাম টেনে ধরতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এইসব ঘুষ বাণিজ্য যারা করছে সেই সব রাঘববোয়ালদের প্রথমে ধরতে হবে। একজন দুজন নয় প্রতিটি সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে নিচের স্তরের ঘুষ বাণিজ্য করা কর্তারা এমনিতেই তা ছেড়ে দেবেন। তখন তাদের অবস্থা হবে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। এই কাজ যে কেবল সরকারের তা ভেবে বসে থাকার উপায় নেই। প্রত্যেকের তার নিজের জায়গা থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। কিছুই যদি করতে না পারি অন্তত চিৎকার করে তো মানুষকে জানাতে পারি। ঘুষখোরদের আবার আতœসম্মানবোধ বেশি! এতে কিছুটা কাজ হলেও হতে পারে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বীজ ছড়িয়ে গেছে খুব সহজে তা দূর হবে না। আমরা তো এটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিতে শিখে যাচ্ছি। সুতরাং এত সহজে আমাদের মুক্তি মিলবে বলে মনে হয় না।
লেখক: মুক্তগদ্য লেখক