যার বুক-দিল আছে সে আল্লাহকে মুহব্বত না করে পারে না। যার অন্তর যত বেশি জিন্দা ও সজীব, আল্লাহর প্রতি তার ভালোবাসাও ততবেশি। দুনিয়াতে যদিও তারা আল্লাহকে দেখে না, কিন্তু দিন-রাত প্রতিটি মুহূর্তে তারা মহান রবের এতবেশি নেয়ামত ভোগ করে যে, তারা আল্লাহর ভালোবাসায় ডুবে থাকে। আল্লাহ প্রেমিক মুমিন বান্দার জন্য আবেগ ও ভালোবাসার অপর নাম হজ।
হজের ঘোষণা
কাবা শরিফ নির্মাণের পর মহান আল্লাহ হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে এ মর্মে নির্দেশ দিলেন যে, বাইতুল্লায় হজের জন্য বিশ্ববাসীকে আহ্বান করো। সেদিন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের মুখের আহ্বানেই চলছে আজকের হজ ও ওমরাহ। রূহের জগতে যারা সেদিন হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আহ্বান শুনতে পেয়েছিলেন, তারাই যুগে যুগে হজ-ওমরা করে আসছেন এবং দুনিয়ার শেষ পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতায় পালিত হবে আবেগ ও ভালোবাসার এ হজ।
হজযাত্রীরা কাবামুখী
মুমিন বান্দা আল্লাহর ভালোবাসায় আত্মহারা পাগলপারা হয়ে পবিত্র নগরী মক্কা, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফায় গিয়ে অবস্থান নেয়। হৃদয়ের আবেগ ও অনুভূতি ঢেলে দিয়ে তাঁর দিদার পাওয়ার সাধনায় আত্মনিয়োগ করে। এ মিছিলে যোগ দিতে সারাবিশ্ব থেকে লাখো হজযাত্রীর কাফেলা প্রতিদিন কাবামুখী। কেউ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আবার কেউ কাবা শরিফ গিয়ে ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে হাজিরা দিচ্ছে। আবেগ ও ভালোবাসার এ এক অনন্য উপমা।
হজ জীবনে একবার ফরজ
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের হজের সুযোগ করে দিয়ে তার একান্ত সান্নিধ্যে ডেকে নিয়ে যান। প্রকৃত আল্লাহ প্রেমিকই হজের সফরে তার ভালোবাসা খুঁজে পান। আল্লাহ তাআলা এসব বান্দার জন্য কাবা শরিফকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে নির্ধারণ করেন। আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়াকে আবশ্যক করেন। নবিজী বলেছেন, আরাফায় উপস্থিত হওয়াই হজ। সাফা-মারওয়া, মিনা, মুজদাফেলাও হজের অন্যতম রোকন বা নিদর্শন। যার প্রতিটি রোকনেই আছে মুমিনের আবেগ ও ভালোবাসা। আল্লাহর প্রতি মুমিনের এ ভালোবাসাই প্রকৃত ভালোবাসা। সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ।
একত্ববাদের সমর্থনই হজ
হজের মাধ্যমে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তার পরিবারের প্রতিটি আমলের অনুসরণ করা হয়। যাতে তাওহিদের তথা আল্লাহর একত্ববাদের আহ্বানের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করা হয়।
হজরত ইবরাহিমের বিভিন্ন নিদর্শনই হজ
আল্লাহর প্রতি আবেগ ও ভালোবাসার অনন্য প্রতীক হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। জীবনে বহু পরীক্ষায় এর প্রমাণ দেন। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার সর্বোত্তম আদর্শও তিনি। তিনি তাঁর জীবনে কত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীনই না হয়েছিলেন!
জীবনের শুরু থেকে তিনি আকল, বুদ্ধি, যুক্তি ও অভিজ্ঞতার দাবি অস্বীকার করে সন্তুষ্টচিত্তে মহান রবের আদেশ পালন করেছেন। আল্লাহর আদেশ পালনের এ মিশনে তিনি একাই লড়েছেন। কারো কাছে মাথা নত করেননি। আল্লাহকে ভালোবেসেই তিনি তা চালিয়ে যান।
স্ত্রী-পুত্রকে নির্জনে রেখে আসা
তাঁকে আদেশ করা হলো- প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ও পুত্রকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে আসার, যেখানে না আছে খাদ্য-পানীয় আর না আছে জীবন ধারণের জন্য কোনো উপকরণ। না আছে কোনো জনবসতি। যা ছিল মানুষের যুক্তি, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার বিচারে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু তিনি মহান রবের ভালোবাসায় এ নির্দেশ মেনে নেন।
প্রাণপ্রিয় পুত্রকে কোরবানি
তাঁকে আবারো নির্দেশ দেওয়া হলো- প্রাণপ্রিয় জিনিস আল্লাহর জন্য কোরবানি করতে, কিন্তু তিনি বার বার কোরবানি করা সত্ত্বেও একই নির্দেশ পেতে থাকেন। অবশেষে কলিজার টুকরো সন্তান ইসমাঈলকে কোরবানি করার সিদ্ধান্ত নেন। ছেলেকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানালে সন্তানও তা বিনা বাক্যে মেনে নেন। স্বাভাবিক জ্ঞান, যুক্তি, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার বিচারে এটিও ছিল চূড়ান্ত বিদ্রোহ। আল্লাহর প্রতি আবেগ, প্রেম ও ভালোবাসায় তিনি সফলতা পান। এ জন্যই আবেগ ও ভালোবাসার
অপর নাম হজ।
হজের মাধ্যমে মুমিন বান্দা মূলত হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জীবনের কোরবানিগুলোকেই অনুসরণ ও অনুকরণ করে থাকেন। এ সবের উদ্দেশ্য হলো-
জীবনভর সে আকল-বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়েছে কিন্তু তার প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো আল্লাহ তাআলার গোলামী করা। দুনিয়ার প্রতিটি কাজে স্বাভাবিক আকল-বুদ্ধি গ্রহণ করুক আর না করুক, মহান আল্লাহর প্রতিটি হুকুম-আহকাম অম্লান বদনে মেনে নেওয়া। এমনকি শরিয়তের উপর আমল করার যে চিরায়ত অভ্যাস, সেটাই বান্দা নির্দ্বিধায় ছেড়ে দেয় শুধু এজন্য যে, এখন এটাই হলো মহান আল্লাহর হুকুম।
তাইতো মুমিন মুসলমান আরাফার ময়দান থেকে মাগরিবের সময় নামাজ না পড়েই রওয়ানা দেয়। এটাই মহান রবের হুকুম। যত রাতই হোক সে মুজদালিফায় এসে মাগরিব ও ইশার নামাজ আদায় করবে। অথচ সে সারা জীবন মাগরিব পড়েছে মাগরিবের সময় আর ইশা পড়েছে ইশার সময়। কিন্তু আরাফায় এটিই ইসলামের বিধান ও হুকুম।
মহান রব মুমিন বান্দার আবেগ ও ভালোবাসার হজের নির্দেশ দেন এভাবে-
وَ لِلّٰهِ عَلَی النَّاسِ حِجُّ الۡبَیۡتِ مَنِ اسۡتَطَاعَ اِلَیۡهِ سَبِیۡلًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ عَنِ الۡعٰلَمِیۡنَ
আর আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য বাইতুল্লায় হজ করা ফরজ, (কিন্তু তা সকলের জন্য নয়) তা সামর্থ্যবান মানুষের জন্য। আর যে তা না মানে (তবে তাতে আল্লাহর কোনো ক্ষতি হবে না, কেননা) আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৯৭)
আল্লাহর এ বিধান পালনই হজ। যা সামর্থ্যবানদের জন্য জীবনে একবার পালন করা ফরজ। মুমিন মুসলমান জীবনে একবার হজ পালনের বিষয়টি তাদের হৃদয়ে লালন করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দিদার পাওয়ার ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন হজ।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে হজ করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর প্রতি আবেগ ও ভালোবাসার প্রকৃত নমুনা উপস্থাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।