বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিকূল আবহাওয়ায় শীর্ষ খাদ্যশস্য ও তেলবীজ উৎপাদক দেশগুলো পড়েছে বিপাকে। খরা পরিস্থিতির কারণে উৎপাদন দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে, যা সরবরাহ খাতকে চাপের মুখে ফেলছে। এ ছাড়া জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধি ও বিশ্বের প্রধান বন্দরগুলোয় কার্গোজট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রাশিয়ার ইউক্রেন হামলা বিশ্বজুড়ে কৃষিপণ্য উৎপাদক ও ব্যবহারকারীদের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এমন এক সংকটাপন্ন সময়ে সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে, যখন কয়েক মাস ধরেই জ¦ালানি ও উৎপাদন উপকরণের দাম আকাশচুম্বী। গম, চাল, ভুট্টাসহ বিশ্বের প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর বাজারদরে ঊর্ধ্বমুখিতা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
যে কোন দুর্ঘটনা বা অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বব্যাপী, খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে। দ্রব্যমূল্য বাড়তে পারে। কিন্তু উৎপাদন বাড়িয়ে নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরা করতে পারলে খুব বেশি সমস্যা হবে না
ফলে নিত্যদিনের খাবারের দাম মেটাতে হিমশিম খেতে হবে ভোক্তাদের। এতে মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলো। রফতানি বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা পলিসি গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে শীর্ষ কৃষিপণ্য উৎপাদক দেশগুলোর সরকার। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশকে তাই সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বর্তমানে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোই খাদ্যপণ্য মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে। বেশির ভাগ দেশই কৃষিপণ্য আমদানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারত, মিশর ও আফ্রিকার দেশগুলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এরইমধ্যে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। চলতি বছরের মার্চে সংস্থাটির বাজার আদর্শ খাদ্যপণ্যের মূল্য নির্দেশক অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ফলে আগামী দিনের জন্য বিশ্লেষকরা খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজার সম্পর্কে নিরাশার বাণীই দিচ্ছেন। এপ্রিলে খাদ্যপণ্যের মূল্যসূচক কিছুটা কমেছিল। কিন্তু তা এখনো গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।
আগামী কয়েক মৌসুমজুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সব শ্রেণির ক্রেতাদের খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধের প্রস্ততি নিয়ে রাখা উচিত। গমের সবচেয়ে বড় আমদানিকারকরা এরইমধ্যে ভবিষ্যৎ সরবরাহ নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তারা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির দিকে ঝুঁকছেন। এ সুযোগে বিক্রেতারা দাম আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক কৃষিপণ্যের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। গোটা দুনিয়ার গম রফতানির ২৫ শতাংশই আসে দেশ দুটি থেকে। পাশাপাশি সূর্যমুখী তেল, ভুট্টা, সার, যব ও শরঘামের অন্যতম প্রধান উৎসও এ দুই দেশ। ওরা এখন যুদ্ধের গোলাবারুদ নিয়ে ব্যস্ত।
যুদ্ধের কারণে এসব পণ্যে সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে কৃষিপণ্য ও খাদ্যপণ্যের বাজার অব্যাহত চাপের মুখে পড়ছে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলো বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। তবে দেশটির রফতানিকারকরা রেলপথে বাণিজ্য অব্যাহত রাখার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। যদিও জাহাজের সক্ষমতার মতো রেলপথে বড় পরিসরে পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া সব গন্তব্যে রেলপথে পণ্য পাঠানোও অসম্ভব। সব মিলিয়ে দুনিয়াজুড়ে বাড়ছে কৃষি আর খাদ্যপণ্যের সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ।
তবে ইউক্রেনের মতো বড় পরিসরে ব্যাহত হয়নি রাশিয়ার গম রফতানি। চীনসহ প্রধান প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশ রাশিয়া থেকে আমদানি অব্যাহত রেখেছে। তবে দেশটি ইউরোপে বাজার হারাচ্ছে। তাই রাশিয়া নতুন বাজার খুঁজছে। রাশিয়া বাংলাদেশকে পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত তেল কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছে গম কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। দু’দেশ নিশ্চয়ই একটা চুক্তিতে আসবে। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
সময়ের প্রয়োজনে আমাদের যা করতে হবে। প্রতিটি সংসারে, যেটা আমার এখনই প্রয়োজন সেটা করব। যেগুলোর এখন প্রয়োজন নেই সেগুলো একটু ধীরগতিতে করতে হবে। দেখতে হবে আমাদের অর্থনীতির ওপর চাপটা যেন না আসে। যেখানে বিশ্বব্যাপী মন্দা, পুরো বিশ্ব একটা দুর্ভিক্ষ অবস্থার দিকে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের সতর্ক থাকতেই হবে। টাকা খরচের ক্ষেত্র থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রেই আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। সম্পদ যেন আমরা অহেতুক ব্যয় না করি। প্রয়োজনে অর্থ সংরক্ষণ করতে হবে।
টাকা-পয়সা খরচের ক্ষেত্রে বা সবক্ষেত্রেই আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। অহেতুক আমরা যেন অর্থ ব্যয় না করি। আমরা যদি খুব ভালোভাবে হিসাব করে চলতে পারি তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। মিশর বিশ্বের শীর্ষ গম আমদানিকারক। দেশটি গমের সরবরাহ নিশ্চিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ একদিকে গমের দাম চড়া, অন্যদিকে কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চল থেকে গম রফতানি বন্ধ।
তথ্য বলছে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রাশিয়ান বাজার আদর্শ গমের দাম প্রায় ৪৬ শতাংশ বেড়ে যায়। মার্চে পণ্যটির দাম টনপ্রতি রেকর্ড ৪৫৫ ডলারে উন্নীত হয়। ২০২২-২৩ মৌসুমে গমের বৈশ্বিক মজুত প্রায় এক কোটি টন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)।
এদিকে যুদ্ধসহ অন্যান্য সংকটের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ার পামঅয়েল রফতানি বন্ধের ঘোষণা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। ফলে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যায়। বিকল্প হিসেবে ব্যবসায়ীরা সয়াবিন ও সূর্যমুখী তেল কেনার কথা ভাবলেও তা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সয়াবিনের প্রধান উৎস লাতিন আমেরিকার দেশগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা চলছে, ফলে তাদের উৎপাদন তলানিতে। অন্যদিকে যুদ্ধের কারণে শীর্ষ সূর্যমুখী তেল রফতানিকারক দেশ ইউক্রেন থেকে সরবরাহ বন্ধ। ফলে সহসাই দাম কমার সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় বেশি বিপাকে শীর্ষ আমদানিকারক দেশ ভারত। পাকিস্তানে এক লিটার ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ রুপিতে। এমনকি সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র,
অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের মতো দেশের জন্যেও মূল্যস্ফীতি সামাল দেয়া চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনার সময় আমি আহ্বান করেছিলাম যে যা পারেন চাষ করুন, ফসল ফলান। এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।’ যে কোনো দুর্ঘটনা বা অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বব্যাপী, খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে। দ্রব্যমূল্য বাড়তে পারে। কিন্তু উৎপাদন বাড়িয়ে নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা নিজেরা করতে পারলে খুব বেশি সমস্যা হবে না।
লেখক: সাংবাদিক।