এমনিতেই রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক ও জনবল সংকট। তার মধ্যে সিনিয়রদের অনুপস্থিতি। তাই রোগীদের একমাত্র ভরসা ইন্টার্ন চিকিৎসক। যেকারণে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা গুরুত্বর রোগী আসার পর চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
আর এ কারনেই সময়মত সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেক রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। ফলে চিকিৎসা অবহেলার অপবাদে প্রায়ই ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সাথে মৃত রোগীর স্বজনদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। আর এ সংঘর্ষের কারণে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা আন্দোলনের নামে করেন কর্মবিরতি আর রোগীর স্বজনরা করেন রাস্তা অবরোধ। তাতে ভোগান্তিতে পরতে হচ্ছে চিকিৎসা নিতে আসা হাজারো মানুষকে। ঘটনাটি দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহত চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র বরিশাল শের-ই-বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের (শেবাচিম)।
গত ১১ জুন রাতে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সাথে মৃত রোগীর স্বজনদের সংঘর্ষের ঘটনার নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংকটে শেবাচিম হাসপাতালের চিকিৎসা ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা দিন দিন বেহাল দশার দিকে যাচ্ছে। পাশাপাশি গোটা হাসপাতাল ইন্টার্ন চিকিৎসক নির্ভর হয়ে পরেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোটা দক্ষিণাঞ্চল তথা বরিশাল বিভাগের মানুষের চিকিৎসার শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল। একসময় হাসপাতালটির ব্যাপক সুনাম ছিলো। দীর্ঘদিন থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা এবং অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম মারাত্মক হুমকির মুখে পরেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ইন্টার্ন চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চিকিৎসক হতে তাদের মৌখিক ও প্রাকটিক্যাল ক্লাস যথারীতি হওয়ার নিয়ম থাকলেও ইদানীং বেশির ভাগ সিনিয়র শিক্ষকরা সময় মতো ক্লাস নিতেও অফিসে আসেন না। একদিকে তারা যেমন নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন না, তেমনি হাসপাতালে ভর্তি রোগী দেখার ব্যাপারেও তারা অনিহা প্রকাশ করেন।
এনিয়ে সম্প্রতিসময়ে সোস্যাল মিডিয়ায় বায়োকেমিস্ট বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ হানিফের একটি ষ্ট্যাটাস ভাইরাল হয়েছিলো। যেখানে তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন-মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় প্রধানশিক্ষক থাকেন কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে। তিনি মাসে ২/৩ দিন অফিস করেন। আবার পরীক্ষা অনলাইনে নিয়ে হাজিরা খাতায় সব শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর রাখেন। ছাত্র-ছাত্রীরা নির্ধারিত ক্লাসে এসে শিক্ষকদের না পেয়ে হাজিরা খাতায় নিজেরা হাজিরা দিয়ে চলে যান। তার ষ্ট্যাটাসের লিংকে অনেকে কমেন্ট করে লিখেছেন, শিক্ষকরা অনেক দাপুটে হয়। এসবের প্রতিবাদ করলে নাকি পরীক্ষায় ফেল করার আশঙ্কা থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান অহিদা সুলতানা খুলনা থাকেন। মাসে তিনি দুইদিন অফিস করেন। বিষয়টি জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। অপরদিকে উপাধ্যক্ষ ডাঃ নাজিমুল হক সপ্তাহে দুইদিন পটুয়াখালীতে দিনভর রোগী দেখেন। এ কারণে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের একদিকে যেমন ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে তারা দক্ষ চিকিৎসকও হয়ে উঠতে পারছেন না।
বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে বার্ণ ইউনিটের কার্যক্রম ॥ দুই বছর বন্ধ থাকার পর পূনরায় চালু হয়েও পরিপূর্ণভাবে সেবা দিতে পারছে না শেবাচিম হাসপাতালের বার্ণ ইউনিট। সার্বক্ষনিক ডাক্তার ও চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারী না থাকায় এমন সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় প্রতিনিয়ত অগ্নিদগ্ধ রোগীদের দূর্ভোগ বাড়ছে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে চালু হওয়া শেবাচিম হাসপাতালের বার্ণ ইউনিট চিকিৎসক শুন্যতার কারণে ২০২০ সালের ১৮ মে বন্ধ হয়ে যায়। এরইমধ্যে গতবছর ২৪ ডিসেম্বর ঝালকাঠিতে লঞ্চে অগ্নিকান্ডের পর এখানে ৮১ জন দগ্ধ রোগী ভর্তি হলে পুনরায় বার্ণ ইউনিট চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ঢাকা ও রংপুর থেকে একজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন রেজিষ্টার ও একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট যোগদান করায় গত ২৩ মে থেকে পুনরায় চালু হয় এই ইউনিট। কিন্তু মিড টার্মের (সার্বক্ষনিক) কোন চিকিৎসক এবং চতুর্থ শ্রেনীর কোন কর্মচারী না থাকায় আবার মুখ থুবড়ে পরেছে বার্ণ ইউনিটের সেবা কার্যক্রম।
তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এইচএম সাইফুল ইসলাম জানান, বর্তমানে এ ইউনিটে প্রফেসর, রেজিস্টার, দুইজন সহকারী রেজিস্টার এবং ইএমও সহ ছয়জন চিকিৎসক ও ১০ জন চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীর পদ শুন্য রয়েছে। পাশাপাশি বার্ণ ইউনিটে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত নার্সের তীব্র সংকট রয়েছে। এখানে কাজ করা ২৩ জন নার্সের মধ্যে মাত্র দুইজন অগ্নিদগ্ধ সেবায় প্রশিক্ষন প্রাপ্ত। অন্যরা আন্দাজের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছেন। সিনিয়র স্টাফ নার্স লিংকন দত্ত বলেন, নার্সদের পক্ষ থেকে বার বার প্রশিক্ষনের দাবি েেতালা হলেও তা কাজে আসেনি।
বার্ণ ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ মারুফুল ইসলাম বলেন, বরিশাল বিভাগের একমাত্র এই বার্ণ ইউনিটটিতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে পাঁচ হাজার অগ্নিদগ্ধ রোগী সেবা পেয়েছেন। এখানে অপারেশন করা হয়েছে অন্তত দুই হাজার জনের। এখানে প্লাষ্টিক সার্জারিসহ সবধরনে সুবিধা থাকার পরেও চিকিৎসক শুন্যতায় রোগীর সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
ভয়াবহ অগ্নিদুর্যোগে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের একমাত্র ভরসা এই বার্ণ ইউনিটটি পরিপূর্ণভাবে চালুর দাবি করেছেন সচেতন বরিশালবাসী।
নিরাপত্তায় নেওয়া হবে ৬০ আনসার সদস্য ॥ শেবাচিম হাসপাতালের নিরাপত্তার জন্য আরও ৬০ জন আনসার সদস্য নেয়ার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত ১১ জুন রাতে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনদের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনার পর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সোমবার সকালে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ এইচএম সাইফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, হাসপাতালে নিরাপত্তার স্বার্থে আগে ৪০জন আনসার সদস্য নেয়া হয়েছিলো। তবে এত বড় হাসপাতালে এই অল্প সংখ্যক আনসার সদস্য দিয়ে নিরাপত্তা দেয়া কষ্টকর। তাই আরও ৬০জন আনসার সদস্য নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই তাদের হাসপাতালে নিরাপত্তায় নিয়োজিত করা হবে।