যাত্রী সেবার নামে দীর্ঘদিন ধরেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে ন্যাশনাল ট্রাভেলস’র বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সমাধানের জন্য জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগও করে আসছেন ভুক্তভোগী যাত্রীরা। কিন্তু অন্য বিষয়ে দাখিলকৃত অভিযোগগুলোর সমাধান করলেও অজ্ঞাত কারণে এই গণপরিবহন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়না বলে অভিযোগ উঠেছে। উত্থাপিত এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে গেলে দেখা যায়, ইতিপূর্বেও ন্যাশনাল ট্রাভেলস’র বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে প্রতিষ্ঠানটি পার পেয়ে গেছে।
সম্প্রতি অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগকারি রাজশাহী মহানগরীর এক ছাত্রী ফারজানা ইয়াসমীন নীপা জানান, আমি রাজশাহী হতে ঢাকা যাওয়ার জন্য গত ২৫ এপ্রিল ন্যাশনাল ট্রাভেলস রাজশাহীর প্রধান কাউন্টার হতে একটি টিকিট ক্রয় করি। যার মূল্য নেয় ১২০০ টাকা। ঠিক তার পরেরদিন (২৬ এপ্রিল) কাজ শেষ করে রাজশাহীতে ফেরার জন্য একই প্রতিষ্ঠানের কল্যাণপুর কাউন্টার থেকে আরেকটি টিকিট ক্রয় করি। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হচ্ছে একদিনের ব্যবধানে একই পথের টিকিটের মূল্য নেয় ১৮০০ টাকা। আর মাত্র একদিনের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন দেখে কাউন্টারে দায়িত্বরত ব্যাক্তির কাছে সরকারিভাবে নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে ব্যর্থ হয়ে বলেন, পরিবহন মালিক সমিতির সিদ্ধান্তে আমরা এই ভাড়া নিচ্ছি। এ বিষয়ে আমার কিছুই করার নেই। তখন কাছে ওই পরিমাণ টাকা না থাকায় আমার এক আত্মীয়র কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে লোন করতে বাধ্য হই। এরপর দেশের সাধারণ জনগনের স্বার্থে বিষয়টি নিয়ে গত ২৪ মে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর ডাক যোগে রেজেষ্ট্রি করে একটি লিখিত অভিযোগ করি। যে অভিযোগটি গ্রহণের রিসিপ্্ট কপিও আমার কাছে সংরক্ষিত। কিন্তু অভিযোগ দাখিলের এক মাস হতে চললেও বিষয়টির কোন অগ্রগতি না হওয়ায় অধিদপ্তরটির ওয়েবসাইডে থাকা নম্বরে অনেকবার যোগাযোগ করেও তাদের কাছ থেকে কোন সঠিক উত্তর পাইনি। দপ্তরটির এক কর্মকর্তা অন্য কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা বলে হয়রানি করাচ্ছেন। কিন্তু আমি একজন মফস্বল শহরের সাধারণ ছাত্রী হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে কোন কুল-কিনারা না পেয়ে আমার সহপাঠিদের পরামর্শে মানবাধিকার সংস্থা ‘সচেতন নাগরিক ফোরাম বাংলাদেশ’-এর শরণাপন্ন হই। এরপর প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছেন, আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তর কোন ব্যবস্থাগ্রহণ না করলে তখন আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব। তবে মানবাধিকার সংস্থা’র পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে এ অবস্থায় গণমাধ্যমের সহযোগিতা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
নায্য বিচার না পাওয়ার সংশয় প্রকাশ করে অভিযোগকারি এই ছাত্রী বলেন, বাল্যকাল থেকে পিতৃহীন, মায়ের সেলাইয়ের টাকা ও সরকারি সহায়তায় পড়াশোনা করে আজ এ অবধি এসেছি। আর বর্তমান সরকার আমাদের মত সাধারণ জনগণের লাইফ স্টাইল চেঞ্জ করানোর জন্য ব্যাপক কর্মযোগ্য বাস্তবায়ন করছেন। আর সরকারের এমন সুফল অম্লান করতে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি সক্রিয় রয়েছেন। আমি এ-ও জেনেছি এই ন্যাশনাল ট্রাভেলস্-এর মালিকপক্ষ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনের সক্রিয় সদস্য। এ কারণে কেন জানি মনে হচ্ছে, সরকারের সাফল্য অম্লান করতেই মাত্র এক দিনের ব্যবধানে একটি টিকেটের ভাড়া ৬০০টাকা বাড়িয়ে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। আমি বিশ^াস করি, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এমন সুক্ষ কুটকৌশল কখনো ভেবে দেখার সুযোগ পায়নি। আর সাধারণ জনগণের পকেট কেটে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থগুলোই যে সরকার বিরোধী কর্মকা-ে ব্যবহার হচ্ছে না তা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে? তাই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা প্রয়োজন।
এদিকে, গণপরিবহন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া যায় একটি তথ্য। প্রাপ্ত সূত্র বলছে, এমন অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে ২০১৭ সালে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তর রাজশাহীর কার্যালয়ে জনস্বার্থে স্বপ্রনোদিত হয়ে চৌধুরী মশিউর রহমান নোমান নামের এক যাত্রী লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু সে অভিযোগটিও অজ্ঞাত কারণে গুরুত্বের সাথে না দেখায় ন্যাশনাল ট্রাভেলস্্ পার পেয়ে যায়। যে অভিযোগের বিষয়ে সোমবার (২০ জুন) দুপুরে কথা হয় জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তর রাজশাহীর সহকারী পরিচালক অপূর্ব অধিকারীর সাথে। তিনি জানান, ওই অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় তা খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।
এরপর খারিজের কারণ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় সেই অভিযোগকারি চৌধুরী মশিউর রহমান নোমানের সাথে। তিনি জানান, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের যথাযথ প্রমানাদি থাকা সত্বেও অজ্ঞাত কারণে জনগণের পক্ষে রায়টি দেওয়া হয়নি। এ কারণে ইতিমধ্যেই তিনি উচ্চ আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। এবার ন্যায় বিচার সাধারণ জনগণের পক্ষে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন চৌধুরী নোমান।
আর অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে ছাত্রী ফারজানা ইয়াসমীন নীপার অভিযোগ যাচাই করতে গিয়ে প্রতিবেদকের সাথেও অসহযোগিতামূলক আচরণ করেন জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক বার মুঠোফোনে কথা হয় জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষন অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. মাগফুর রহমান ও মাসুম আরেফিনের সাথে। একপর্যায়ে সহকারী পরিচালক মো. মাগফুর রহমান বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ কেন্দ্রের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। এ সময় অভিযোগ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগের নম্বর চাইলে তিনি বলেন, এটা আমার কাজ নয়। এ সময় যোগাযোগের নম্বর দিয়ে সহযোগীতা করতে পারবেন না বলে সাফ জানিয়ে অন্য কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলেন। পরে মাসুম আরেফিনের অভিযোগ কেন্দ্রের নম্বর দিয়ে সহযোগীতা করলেও সেই নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।