সাহেদ মারা যাওয়ার আগে মেহরিন কোনদিন ভাবেনি সংসারটা এতটা জটিল। সাহেদ ঈগলের মতো পক্ষ বিস্তার করে মেহরিন আর ওদের একমাত্র অসুস্থ সন্তান পানসিকে আগলে রেখেছিল সব ঝড়-ঝাপটা নিজের পিঠে রেখে। মেহরিনের চাওয়ার আগেই বাসাটাকে আধুনিক অনুষঙ্গে ভরে তুলেছিল কেবল প্রয়োজনেই নয়Ñ গভীর ভালোবেসেও। যেন মেহরিন আর পানসি ওর দুটো সন্তান। পানসি দশ দিন ভালো থাকে তো বিশ দিন বিবর্ণ। পানসির ভালো থাকার ক’টা মেহরিনের পৃথিবী উজ্জ্বল, পায়ে অদৃশ ঘুঙুর, ঘরের চারকোণে নিঃশব্দ সঙ্গীত। সাহেদের স্বস্তি। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে অফুরান আনন্দের বন্যা। মনে হয় পানসি একেবারে ভালো হয়ে উঠেছে। আর কোনদিন ও ফ্যাকাসে ঠোঁট আর গরম নিঃশ্বাস নিয়ে ওদের ফের হতাশার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে না। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে থলে থলে রক্ত শরীরে ঢুকিয়ে আর ওকে রক্তিম করতে হবে না। কিন্তু আবার যে কে সেই। একগাদা পুতুলের মধ্যে মেয়ে সন্ধ্যার সময় শুয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে ফিরে মেহরিন চমকে ওঠে। না না সন্ধ্যার আলো মুখে পড়ায় ওরকম হলুদাভ লাগছে। আসলে পানসি ভালো আছে। কিন্তু গায়ে হাত দিয়ে দেখতেও ভয় পায়। যদি দেখে গা গরম। তার মানে আবার বিশ-পঁচিশ দিন মেয়েকে নিয়ে মেহরিনের সেই নিরানন্দ জীবন। সাহেদ অফিস থেকে ফিরলে মেহরিন খানিকটা ভারমুক্ত হয়। সাহেদ মেয়ের সেবার সব দায়িত্ব নিজের ওপর টেনে নেয়। এভাবে আট বছর নীরবে যাবতীয় ভার বুকে বয়ে বেড়াতে বেড়াতে একদিন অফিস থেকে ফেরার মুখে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে নিজেই ভেঙে পড়ে। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সের বিনয়ী কম কথা বলা কাজপাগল স্ত্রী-কন্যাঅন্তপ্রাণ সাহেদ মাহমুদ সিঁড়ির মধ্যেই শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
আট বছরের পানসিকে নিয়ে মেহরিন অথৈ সাগরে। বাবাহারা মেয়েটি যেন বোবা পাথর। মেহরিন তো জানেই না কীভাবে সংসারের চারকোণ গুছিয়ে চলতে হয়। সাহেদের ভেতর ও প্রতিনিয়ত দেখতে পেয়েছে একজন পিতাকে। এক ছায়াময় বটবৃক্ষের উপস্থিতি। ওর আর পানসির ওপর একই ছায়া। যে মেহরিন মেয়ের সুস্থতার দিনগুলোতে নিজেকে দেখত ছোটবেলার কুমার নদের ধারঘেঁষে হাঁটা এক কিশোরী। তার চুল উড়ছে, ওড়না উড়ে গিয়ে বাবলার ডালে আটকাচ্ছে, স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ বৃষ্টি। তার পাশে আচমকা ছাতা মেলে ধরা কাঁপন জাগানো পুরুষালি গন্ধ। ছুটে পালাতে গেলে কঠিন হাতের অনুশাসন। পা চালাতে অবশ পা। ভেজা শরীরে চোরামুগ্ধ দৃষ্টির টের পাওয়া। সেই ঘাম-বৃষ্টির ঘ্রাণ, সেই একটুকু ছোঁয়া, সেই দপদপে উন্মাতাল শরীরের আকুতি মেহরিন একা হলেই ঘুমে না জাগরণে তাকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরত তা সে বলতে পারে না। কিন্তু সাহেদের অনাবিল আদর, নিখাদ মমতায় মেহরিন কোনদিন সেই ঘ্রাণ সেই কাপুঁনিকে আশপাশেও খুঁজে পায়নি। আবার ‘কী পাইনি’র উত্তরও ওর জানা নেই। শুধু পানসি ভালো হয়ে উঠলে আর কিছুই দরকার হতো না। ডেকে ডেকে স্মৃতিকাতরতার কোন মানেই হয় না। সাহেদ তো কোন কিছুই ওর অপূর্ণ রাখেনি। কিন্তু সাহেদ কেন এত বেশি ভালো। সাহেদ কেন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে পানসিকে ঘুম পাড়ানোর পর? কেন একটু বেহিসাবি রাত জাগেনি? কেন অনেক রাতে ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে মেহরিনের সুদূরিকা চোখে পড়ে দেখেনি কবিতার অন্ত্যমিল? সাহেদের ধাঁচটাই কি ওরকম না মেয়ের অসুস্থতা ওকে ক্রমেই হিসাবি করে তুলেছিল? নাকি বেশি পেয়ে পেয়ে মেহরিনের না-পাওয়ার জন্যই ছিল বিলাসী অভাবক্ষ
আজ সব দায়দায়িত্ব মেহরিনের। ওর কিছুর প্রয়োজন নেই। কোন বেহিসেবি রাতের স্বপ্ন ও দেখতে চায় না। কেবল সাহেদ ফিরে আসুক। পানসিকে বুকে জড়িয়ে মেহরিনকে খানিক স্বস্তি এনে দিক। একা এ ভার সে কেমন করে বইবেক্ষ
সাহেদের সহকর্মী অকৃতদার আজাদ রশিদ আগেও মেহরিনদের বাসায় এসেছে। তবে সব লোকনিন্দা উপেক্ষা করে সে সময় আজাদ যদি পাশে এসে না দাঁড়াত মেহরিনের একার পক্ষে অসুস্থ পানসিকে বাঁচিয়ে রাখাই কঠিন হতো। প্রবাসে থাকা মা আর ভাই এসে যে ক’দিন ছিল সে ক’দিন কেবল পানসিকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল মেহরিন। বাবার শূন্যতা মেয়েকে একমুহূর্তের জন্যও অনুভব করতে না দেয়ার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু অতিসংবেদনশীল মেয়েকে বাবার শার্ট নাকে চেপে ধরে কাঁদতে দেখেছে মেহরিন। বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য মা ভাই পীড়াপীড়ি করলেও মেহরিন দেশ ছেড়ে কোথাও থাকার কথা ভাবতে পারে না। পরে যদি কখনও মনে হয় তাহলে ভেবে দেখবে সে।
সাহেদের অফিসের পাওনা, ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার সবকিছুর হিসাব বুঝিয়ে আজাদ সেদিন সন্ধ্যার পর ঝুলবারান্দায় চায়ের কাপ হাতে দাঁড়ালে লোডশেডিং। মোটামুটি গুছিয়ে দিয়েছে আজাদ সাহেদের টাকাণ্ডপয়সার ব্যাপারগুলো। কিন্তু মেহরিন কতটা বুঝেছে সে সম্বন্ধে আজাদ সন্দিহান। পানসি ঘুমুচ্ছে। আকাশের চাঁদও খানিকটা ঝুলে এলো। আজাদ চাঁদের দিকে চেয়ে বললÑ
‘আচ্ছা কখন আপনার মনে হয় চাঁদ হাঁটছে আর মেঘ স্থির। আর কখন মেঘ দৌড়ায় আর চাঁদ দাঁড়িয়ে থাকে?’
‘যখন পানসি ভালো থাকে তখন চাঁদ হাঁটে মেঘ স্থির। কিন্তু পানসি এখন ভালো নেই তবুও চাঁদ কেন হাঁটছে বুঝতে পারছি না। আপনার?’
‘আমার ঠিক উল্টোটা। চাঁদ হাঁটলে আমার অস্থির লাগে। আর চলিষ্ণু মেঘের সঙ্গে আমি অলস হাঁটি। গন্তব্য নেই। হাঁটতে হাঁটতে তেপান্তরের মাঠে গিয়ে দাঁড়াই। সেই মাঠটা কিন্তু আমাদের গ্রামের নান্দীরচর। আসলে ছেলেবেলা আমাকে খুব টানে। মেঘ আমাকে ওখানেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’
‘আর আমাকে টেনে নেয় ঝুম্ বৃষ্টি। পিছল পথ। ভেজা চুল। বৃষ্টি বাতাস আর কীসের যেন কাঁপনলাগা দুপুর।’
তারপর নীরবতা। সন্ধ্যার কোমল আলো মেহরিনের øিগ্ধ চিবুক বেয়ে গলায় ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কনে দেখা আলো। বধূ কোন আলো লাগল চোখে। বাতাসে মেহরিনের নরম আঁচল হাত হয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা আজাদের পিঠে গিয়ে পড়ে। মেহরিনের নির্ভরতা ওর কাছে আঁচলের চেয়ে কোন অংশে ভারী নয়। কিন্তু মেহরিন কি সে ভারটুকুও ওকে নিতে দেবে না? চা শেষে নিজের কাপ এক হাতে আর এক হাতে আজাদের খালি কাপ চেয়ে নিয়ে ফিরে আসতে গেলে আঁচল পেয়ে যায় স্বাধীনতা। ঘাড় থেকে খসে পড়ে হাতের ওপর। ব্লাউজের নিচু গলায় উন্মুক্ত হয় নিটোল শিল্প। অস্বস্তির কয়েক মুহূর্ত। আজাদ পরম মমতায় আঁচল তুলে নিয়ে মেহরিনের পিঠে ছড়িয়ে দেয়। খোলা পিঠে আজাদের হাতের ছোঁয়া। মেহরিনের রেশম ত্বকে ঝিরিঝিরি বাঁশপাতার কাঁপন।
আজাদ বলেÑ
‘তাহলে কাল থেকে আমার ছুটি।’
‘বারে, আমি একা একা সব সামলাব কী করে?’ বলে নিজেকে সামলাতে মেহরিন দ্রুত ঘরের ভেতর চলে যায়। পানসি জেগে উঠেছে।
সাহেদের অন্য সহকর্মী বন্ধুরা বলাবলি শুরু করেছেÑ
‘ভালোই তো। আজাদও একা। উনিও। হলে খারাপ কি?’
‘তা বলে বছর না ঘুরতেই?’
‘একে সুন্দরী তার ওপর অসুস্থ মেয়ে।’
‘একা থাকাটাও নিরাপদ নয়।’
‘যাদের ভালো তাদের বুঝতে দে রে ভাই।’
অ-সংসারী মেহরিন মেয়ে বুকে নিয়ে কোন কূলকিনারা পায় না। আজাদও যখন তখন আসার ছুতো খুঁজে পায় না। মেহরিন মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেÑ
‘আজাদ কাকু কেমনরে পানসি?’
‘ভালো’
‘বাবাই-এর মতো?’
‘না’
‘তাহলে?’
‘কাকুর মতো’
‘ও যদি আমাদের সঙ্গে থাকে কেমন হয়?’
‘কোন ঘরে?’
মেহরিন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন জবাবে মেয়েটি খুশি হবেক্ষ
‘এই বাসাতেই’
‘থাক না’।
মানে কী? মেয়ে কি চাচ্ছে না, নাকি রাজি? আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে মেহরিনের ভারি লজ্জা লাগছিল। কলিংবেল। মেহরিন জানে এ বেল আজাদের। ছুটে গিয়ে দরজা খুলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পানসি কী ভাববে? মেয়েকে কোলে নিয়ে বসেই থাকে। পানসিই বলেÑ
‘আজাদ কাকু বোধহয়। যাও মা খুলে দাও।’
মেহরিন অস্থির হয়। কিন্তু অনিচ্ছা দেখিয়ে দরজা খোলে। আজাদের হাতে চকোলেটের বাক্স, টেডি বিয়ার আর পানসির একগাদা টেস্ট-রিপোর্ট। পানসির অসুস্থ চোখে ঝলমলে আনন্দ। মেহরিন যেন ওর সম্মতি পড়ে ফেলে।
তবে পানসি হ্যাঁ না কিছুই বলে না। ও যেন একেকদিন একেক রকম। অসুস্থতার দিনগুলোতে আজাদ ওর বিছানায় গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলে পানসি নিজের হাত দিয়ে আজাদের হাত ধরে রাখে। মেহরিন নির্ভার হয়। মনে হয় এ বেলা কথাটা পেড়েই ফেলা যাক। ওমা! মেহরিন একটু সাহস পেয়ে আজাদের পাশাপাশি দাঁড়াতেই পানসি আজাদের হাত ছেড়ে দিয়ে কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে। আবার কোনদিন যখন দুপুরে পানসিকে পাশে নিয়ে চোখের ওপর হাত রেখে শুয়ে থাকা মেহরিনের চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে তখন পানসি বলেÑ
‘মা, ও মা, খারাপ লাগে?’
‘হ্যাঁ মা’
‘বাবাই মরে গেছে তাই’ক্ষÑ মেয়ে যেন নিশ্চিত হতে চায় মা আসলে কেন কাঁদছে।
মেহরিন ফোঁপাতে থাকে। সাহেদের চলে যাওয়া, ওর অনভিজ্ঞ সংসারজীবন, অসুস্থ মেয়ে নিয়ে অসহায়তা, আজাদকে সরিয়ে রাখাÑ একসঙ্গে এতগুলোর ব্যাখ্যা সে ওইটুকুন পানসিকে কীভাবে দেবেক্ষ
মেয়ে খানিক চুপ করে থেকে কী যেন বুঝে নিয়ে বলেÑ
‘আজাদ কাকুটা যেন কী! রাতে আমাদের বাসায় থাকলেই তো পারে।’
মেহরিন কাত হয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মেয়ে মায়ের চোখ মুছিয়ে দেয়। মায়ের ঠোঁটের কোণে বাঁকা চাঁদ। পানসির মুখ পানসে।
সেই রাতে প্রথার ব্যবধান দূর হলে আকাশে চাঁদ। মেঘের ঘষা লেগে চাঁদটা যেন ধেবড়ে যাওয়া সিঁদুরের টিপ। চাঁদ ছোটে না মেঘ দৌড়ায়? কেউ কি দেখছে তা? ওরা দুজনেই তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মেহরিন আর আজাদ। পাশাপাশি। এত কাছে তবুও ছুটে চলা চাঁদের গন্তব্য নেই। মেঘ যেন এবার পথ আটকালো। ঘন আঁধারে সমুদ্র আছড়ে পড়ল বালিয়াড়িতে। মেহরিনের কানে যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা আজাদের শংখহƒদয়। কী তুমুল গর্জন! মেহরিন আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়তে চায়। আজাদের অনেক তৃষ্ণার চাতক ঠোঁট ঝুঁকে পড়ে ঠোঁটের পানি শুষে নিতে চায়। কিন্তু তারও আগে মেঘ সরে যায়।
‘মা, আমাকে নিয়ে শোবে চলো’Ñ চাঁদের ঝকমকে আলোয় পেছনে দাঁড়ানো মুখ নিচু করা পানসির দৃঢ় আদেশ। ছিটকে সরে যায় মেহরিন। আজাদ হাত বাড়িয়ে পানসিকে কোলে তুলে নিতে গেলে সে মায়ের গা-ঘেঁষে দাঁড়ায়। মা মেয়েকে বুকে তুলে নিয়ে মেয়ের বিছানায় চলে যায়।
পানসি মায়ের নতুন শাড়ির আঁচল আঙুলে পেঁচিয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। মেয়ের গায়ের ওপর হাত বিছিয়ে দিতেও সংকোচে মরে মেহরিন। ছি! ছি! আগে তার অসুস্থ মেয়েটি না তার নতুন জীবন? তখনও ওর বুকের ভেতর কড়া নাড়ার শব্দ। চোরা চোখে দরজার দিকে তাকায়। না, কারও ছায়া নেই। হাত চলে যায় মেয়ের মাথায়। অবচেতন মনে ওকে ঘুম পাড়ানোর প্রচেষ্টা। যদিও মনে মনে বলে মেয়েকে ছেড়ে ও কোত্থাও যাবে না, কিন্তু গলায় ঘুমপাড়ানি গানের কলি। ও নিজে কত রাত ঘুমায়নি কিন্তু ওর চোখ জেগে আছে আরও রাত জাগার প্রত্যাশায়। কোন একসময় ওর নিজের মাথায় কার মমতার স্পর্শ। শব্দহীন নিঃশ্বাস নিয়ে অপেক্ষার মানুষটির নীরব আহ্বান। মেহরিন সন্তর্পণে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে আহ্বানে সাড়া দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। নিচে পা ফেলতেই মেয়ের আঙুলে জড়ানো শাড়িতে টান লাগে। পানসি উঠে বসে। আজাদ নিজেকে সরিয়ে নেয় আড়ালে। তখন সকালের রোদ সব আড়াল ভেদ করে জানালা দিয়ে ঢুকে মেঝের ওপর আলসেমিতে গা গড়িয়ে নিচ্ছে।
দিন কেটে যায়। পানসির অভিমানকে ওরা দুজন কেউ ছোট করে দেখে না। ওরা বুঝে নেয় কোথায় পানসির অস্থিরতা। একা আজাদের সঙ্গে পানসি সহজ। কথা বলে। গান গায়। ছবি আঁকে। কিন্তু আজাদ আর মেহরিনকে একসঙ্গে একটু হেসে কথা বলতে দেখলেই পানসি অসুস্থ হয়ে পড়ে। মেয়ের চোখের রঙ কখন নি্রভ হয়, কখন চোখের কোল বসে যায় মেহরিন সে সূচিপত্রের সতর্ক পাঠক। অসুস্থ মেয়েটি যদি আরও অসুস্থ হয়ে যায়? কিছুদিন গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে মনে করে ওরা অধরা মাধুরী নিয়ে একই ছাদের নিচে তৃষ্ণার্ত রাত্রিদিন যাপন করতে থাকে। সাহেদের জন্য এমন টান তো মেহরিন বিয়ের পরপরও কোনদিন অনুভব করেনি। দূরে দাঁড়িয়েও আজাদের শরীরের ঘ্রাণ ওকে এমন উন্মাতাল করে তোলে কেন? কবে ওর বুকের মধ্যে ও নিজকে সমর্পণ করতে পারবে? নিবেদনের কান্না কি আজাদ বোঝে? কেন বুঝবে না? আজাদের একটুকু ছোঁয়াতেই ওর সারা শরীর তাহলে কেন নিভৃত সময় দাবি করে? সাহেদের সঙ্গে সাত বছরের বিবাহিত জীবনে শরীরের চাহিদা যে মেটেনি তা তো নয়। তাহলে আজাদের জন্য শরীরে এমন কুমারীর চাওয়া কেন? মেয়ের ক্ষোভ-ঈর্ষাকে মূল্য দিতে গিয়ে মানুষটাকে আর কত কষ্ট দেবে? আজাদ জানে দুপুরে পানসিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ওর মা। একদিন আকণ্ঠ পিপাসা নিয়ে আজাদ দুপুরে বাসায় আসে মেহরিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে। বেড়াল পায়ে খুব সন্তর্পণে দরজা খুলতেই পায়ের নিচে জলতরঙ্গ। জলে ঝাঁপ দেয়ার মুহূর্তেই পেছন থেকে ‘মা’ ডাক।
অনেক দ্বিধা নিয়ে এক দুপুরে মেয়ের সঙ্গে কথা বলেÑ
‘পানসি আমার পানসি তরী, আজাদ কাকুকে কি তুই বাবাই বলে ডাকবি?’
‘কী দরকার? কাকুতেই তো বেশ চলে যাচ্ছে’Ñ সাড়ে আট বছরের মেয়ের কী স্পষ্ট উত্তর।
‘না মানে, বললে ও খুশি হয়।’
‘কার খুশি চাও মা? আমার না ওর?’
‘তোর তোর তোর।’
মেহরিনের গলায় কি অধৈর্যের সুর? পানসি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মা কি রাগ করে বলল না সত্যি করেই? ব্যাকুল হয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মেহরিন কাঁদে। অনেকক্ষণ কাঁদার পর নরম গলায় বলেÑ
‘আমার কাছে তোর বড় কেউ নয় পানসি। কিন্তু ও তো তোকে বাবার মতোই ভালোবাসে।’ মেয়ে কী বুঝে বললÑ
‘ঠিক আছে।’
এই ঠিক আছে-এর সম্মতিতে মেহরিন স্বস্তি-অস্বস্তির দোলায় দুলতে লাগল। এ কি তার মেয়ের আরও বেশি অভিমানের কথা? তা না হলে রোজ রাতে আজাদ এলে টেবিলে খাবার দেয়ার সময় পানসি গিয়ে চেয়ারে বসে থাকে। মেহরিন যতক্ষণ ডাইনিংয়ে থাকে পানসিও ততক্ষণ। মায়ের কাজ শেষ হলে মায়ের হাত ধরে বিছানায় নিয়ে আসে। সেদিন ‘ঠিক আছে’ বলার পর পানসি কেন খাবার টেবিলে গিয়ে বসল না? কেন চোখের নজরদারিতে মাকে বন্দি রাখল না? কেন খাওয়া শেষ হওয়ার পরেও মাকে বিছানায় আসতে বলল না? তার এক ফোঁটা অসুস্থ মেয়েকে কষ্ট দিয়ে মেহরিন কেবল শরীরের ক্ষুধা মেটাতে আজাদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়বে? এ কোনদিন হয়? আজাদ মুখে কিছু না বললেও পানসির আচরণে পরিবর্তন হয়েছে দেখে মেহরিনকে রাতে পাশে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। কিন্তু মেহরিন পারে না। আজাদকে একটু ছোঁয়াও না দিয়ে পানসির পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে একটা হাত মেয়ের পেটের ওপর বিছিয়ে দিয়ে বোঝাতে চায় সে এসে গেছে। কিন্তু যে মেয়েকে এ দুই মাসে রাতে যখনই চোখ খুলেছে তখনই চোখ মেলা অবস্থায় দেখতে পেয়েছে সেই তাকে এই প্রথম ঘুমুতে দেখল। ইচ্ছে হল ঘুমন্ত মেয়েকে জাগিয়ে দেখায় যে ও রোজকার মতো ওর বিছানাতেই চলে এসেছে। মেয়ের মাথায় একটু জোরেই আঙুল বোলাল যাতে চোখ মেলে মাকে একবার দেখে। যে অসুস্থ মেয়ে সারা রাত জেগে মাকে পাহারা দেয় সে মেয়ে ঘুমালেও তাকে রেখে মেহরিন আজাদের কাছে যেতে পারবে না।
লম্বা ছায়া মেহরিনের বুকের ওপর। আজাদ হাত বাড়িয়ে চুপিসারে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাত থিরথির করে কাঁপছে। যেন শীতের পাতার বসন্তকে আহ্বান।
‘এসো’
‘না, থাক’
‘পানসি ঘুমায়’
‘তবুও’
‘কেন?’
‘ও যদি জেগে ওঠে’
‘আচ্ছা, তাহলে যাই’
‘না, এখানে দাঁড়িয়ে থাকো’
এ কথাগুলো ওরা কেবল চোখের ইশারায় বলে। তারপর সারা রাত একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেয়।
পরদিন সকালে মেয়ের ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত মেহরিন ওকে ছেড়ে ওঠে না। আজাদ নিজের ঘরের বিছানায় রাতজাগা চোখের ওপর হাত বিছিয়ে শুয়ে। মেয়ে বিছানায় উঠে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মা দেখে মেয়ের দুই চোখ জবা ফুলের মতো লাল। ঠোঁট ফ্যাকাসে। মুখের চামড়া নি্রাণ। বুকে জড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে মেয়ে নেতিয়ে পড়ে মায়ের কোলে। মেহরিন চিৎকার করে ওঠে। আজাদ ছুটে এসে খানিক হতবাক হয়ে চেয়ে থেকে পানসিকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়ায়। আজাদের সঙ্গে মেহরিনের বিয়ের পর এই প্রথম পানসি বেশি অসুস্থ। ওর বাবা মারা যাওয়ার পরপরই ঠিক এ রকম একবার হয়েছিল। সেদিনও আজাদ ছিল মেহরিনের পাশে। আজ আজাদের পাশে মেহরিন। প্রায়-অচেতন পানসির নাকে অক্সিজেন নল। রক্তের ব্যাগ থেকে পড়া ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঢুকে কখন তার মেয়ে স্বাভাবিক রঙ ফিরে পাবে, কখন ‘মা’ বলে ডাকবে, মেহরিন পলকহীন চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজাদ ওষুধ, ডাক্তার, রক্ত, টেস্টের জন্য ছোটাছুটি করে। বারবার ফিরে এসে ভেঙে পড়া মেহরিনের পাশে দাঁড়ায়। মেহরিন একটু স্পর্শের জন্য ভেতরে ভেতরে আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। আজাদ কি ওর পিঠের ওপর একটু হাত রাখবে? এলোমেলো চুলগুলো কপাল থেকে তুলে দেবে? মমতার আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছে দেবে? কিন্তু সাবধানী আজাদ ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে। কী জানি পানসি কখন চোখ মেলে চায়। ওর সুস্থতার জন্য এ রসনাটুকু সংবরণ করা কী এমন কঠিন! নাকি গত রাতে মেহরিন ওর ডাকে সাড়া দেয়নি বলে ওর অবচেতনে অভিমানক্ষ
দুটো দিন চলে যায়। পানসির শরীরের রঙ ফেরে না। তৃতীয় দিন ডাক্তার-নার্স হঠাৎ ব্যস্ত। রক্ত বের করে নতুন রক্ত প্রবেশ করাতে হবে পানসির শরীরে। আজাদ অফিসে হাজিরা দিয়েই ফিরবে বলেছে। অপারেশন থিয়েটারের ভেতর পানসি। অসহায় বিপন্ন মেহরিন দশতলার বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে আজাদের অপেক্ষায় চেয়ে থেকে আবার অস্থির পদচারণায় সময় পার করতে চাচ্ছে। সময় এগোচ্ছে না বরং মনে হচ্ছে ও কোন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে, একটার পর একটা ট্রেন ওর সামনে থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। এতক্ষণের ত্রস্ত পায়ের নার্স কেমন শ্লথ ভঙ্গিমায় দরজা ঠেলে ওকে ইশারায় ভেতরে আসতে বলে। মাত্র দশ কদম দূরের দরজা। অথচ মেহরিনের মনে হয় ও পৌঁছতে পারছে না। ওর পা জগিং মেশিনের ওপর। শুধু চলছে। গন্তব্য নেই। ডাক্তার-নার্স বেডটি ঘিরে দাঁড়িয়ে। কারা যেন ওকে জায়গা করে দিল বিনয়ের সঙ্গে। ওর মনিটরে সমান্তরাল রেখাগুলোর দিকে চোখ চলে যায়। ওর তখন মনে হয় ওই চলমান রেখাগুলো যেন রেললাইন। ও দাঁড়িয়ে আছে তার ওপর। খুব দুলছে। কে যেন পাশ থেকে বলছে ‘নিজেকে সামলাতে হবে তো’।
অনেক পরিচিত সুদূরময় ঘ্রাণ মেহরিনকে সামলে নেয়। একটা দেয়াল যেন ইট-সুরকির হাত বের করে ওকে ধরে ফেলে। মেহরিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে এই প্রথম নিজেকে আজাদের বুকের মধ্যে আবিষ্কার করে। কোন আশঙ্কা কোন সংকোচের শাসন ওকে আর আজাদকে দুদিকে ঠেলে দিল না। ডাক্তার তখন পানসির খুলে থাকা প্রাণহীন চোখ হাতের কোমল পাতা দিয়ে বুজিয়ে দিচ্ছিলেন।