আমাদের পিতা মরহুম মোঃ বদিউজ্জামান ওরপে ‘বদু মিয়া’ কোন বিখ্যাত বা স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন না, কোন নেতা বা বড় ব্যবসায়ীও ছিলেন না। নিজ এলাকায় তিনি একজন সজ্জন ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে লেখার উদ্দেশ্য তাঁর সম্বন্ধে ঢাক-ঢোল পিটানো নয় বা তাঁকে নূতন করে পরিচয় করে দেয়া নয়। তিনি শুধুই আমাদের পিতা। তবে আমাদের অর্থাৎ তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি যেভাবে ভাবনা পোষণ করতেন এবং পরিকল্পনা করেছেন তা শুধু আমাদের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও অনুসরণীয়। একজন সফল পিতা হিসেবেই তিনি পরিতৃপ্তি নিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। আমার ¯েœহময় পিতা মরহুম বদু মিয়া ১৯৯৭ সালের ১৪ মে আমার কোলেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। দীর্ঘদিন রোগাক্রান্ত শরীর নিয়ে এই দীর্ঘ হায়াত তাঁর পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু মহান আল্লাহতায়ালা তাঁকে এই হায়াত দিবেন এবং আমাদেরকে অর্থাৎ তাঁর সন্তানদেরকে তিনি প্রতিষ্ঠিত দেখে যাবেন এটিই আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন। সেজন্য অশেষ শুকরিয়া। তাঁর মৃত্যুর সময় আমি বাংলাদেশ মিলিটারী একাডেমিতে কর্মরত ছিলাম। তাঁর শারিরীক অবস্থার অবনতির খবর পেয়ে আমি আমার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের মাছিমনগরে একাই চলে আসি। মৃত্যু শয্যায় তাঁর পাশে থাকার সুযোগ দেওয়ার জন্যও মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা। পরে মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আমার স্ত্রী সংগে সংগেই চলে আসেন। অন্য ভাইয়েরাও দাফনের আগেই আসেন। আমাদের বাড়ির সামনেই নূতন করে তৈরী করা কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করি। দু’বছর পর আমার ¯েœহময়ী মায়ের মৃত্যু হলে তাঁকে স্বামীর পাশেই সমাধিস্থ করি। আজ ২৫ বছর (জুন ২০২২) অতিবাহিত হল। চাকুরীর সুবাদে যেখানেই থাকি না কেন বছরে কয়েকবার বাড়িতে সপরিবারে আসি এবং দৈনিক দু’বার জিয়ারত করি। একবার সূরা ইয়াসিন ও অন্য একবার সূরা আর-রাহমান তেলাওয়াত করি জিয়ারতের সময়। আমার পিতার প্রিয় সূরাহ ছিল এ দুটি। উল্লেখ্য, তিনি সুন্দর কোরআন তিলাওয়াত করতেন। আমার কোরআন পাঠের হাতে খড়িও তাঁরই হাতে। তিনি লক্ষ্মৌ ছাপার কোরআন শরীফ রাখতেন, আমিও সেটি পড়তাম। ইতোমধ্যে আমাকে কোরআন শরীফ পড়ানোর জন্য একজন মৌলভী (‘মুন্সী’ বলা হত তখন) ঠিক করা হল। তিনি আমাদেরই দুই গ্রাম পরের। তিনি এসে লক্ষ্মৌ ছাপা পড়তে পারেন না বলে জানান এবং সেখানেই শেষ। এরপর পিতার নিকট চর্চা করি এবং বড় হওয়ার পর নিজে নিজেই চর্চা করতাম। এই চর্চাটা আজও স্থায়ী রয়েছে এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ।
আমার পিতা ‘বদু মিয়া’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। আমার জেনারেশনের কাছে তিনি ‘বদু কাক্কু’, আরো সিনিয়রদের কাছে ‘বদু ভাই’ ছিলেন। তাঁর জন্ম এক সাধারণ কৃষক পরিবারে। কিন্তু তিনি নিজে কৃষক ছিলেন না, তবে কর্মজীবী ছিলেন। তাঁর ছয়-সাত বছর বয়সেই পিতা জালাল উদ্দিন মোল্লা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবনের সংগ্রাম শুরু সেখান থেকেই। তিন বড় বোনের মধ্যে তিনি একমাত্র ভাই। বোনদের বিবাহ হয়ে গেলে তার মা জোবেদা খাতুন, অর্থাৎ আমার দাদী অন্যত্র বিয়ে করেন। ফলে কৈশোরেই তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। তখন পূর্ব বাংলার মানুষ ছিল কলকাতা কেন্দ্রীক, এখন যেমন ঢাকা। ভাগ্যচক্রে তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘নওরোজ’ পত্রিকার ছাপাখানায় কম্পোজার ও পরে প্রুফ রীডার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। পত্রিকার বিপণনেও তিনি সংযুক্ত ছিলেন। এই সুবাদে তিনি কবির সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর সাংস্কৃতিক আসরে যোগদান করতেন। সেখানেই তাঁর গান শেখা এবং নাট্যাংগণে সম্পৃক্ততা। এর প্রতিফলন ঘটে ভারত বিভাগ অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরপর তাঁর দেশে চলে আসার পর। নিজ গ্রাম মাছিম নগর- খিলবাইছায় আমাদের ছোট বেলায় বছরে একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হতো। সেগুলোর রিহার্সেলে ও মঞ্চায়নে তিনি মূখ্য ভূমিকা রাখতেন। নাটক মঞ্চস্থকালে তিনি প্রম্প্ট্ (চৎড়সঃ) করতেন। আর দৃশ্য পরিবর্তনের ফাঁকে তিনি নজরুল গীতি গাইতেন। দু’একটা গান মনে পড়ে Ñ “রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ, ”খোদা এই গরীবের শোন শোন মোনাজাত”। নজরুলের নাত এবং গজলও তিনি গাইতেন। তখন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ডায়লগ মুখস্থ করত না। পর্দার অন্তরালে যিনি চাপা গলায় প্রম্প্ট্ করতেন তাঁর হুবহু উচ্চারণ করে অভিনয় করত। এমন কি উচ্চারণের ভংগীটাও প্রম্পটার করে দিতেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সেভাবেই অভিনয় করতেন। পরবর্তীকালে মরহুম সুজায়েত উল্লাহ ভূঞা, মরহুম ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ উল্লাহ ফিরোজ,কামাল পাশা চৌধুরী (হিরু ভাই) তোফায়েল মাস্টার, লুৎফে রাব্বি (নটু) এবং আমি নিজেও প্রম্পটার হিসেবে কাজ করতাম। তখন খিলবাইছা লক্ষ্মীপুর থানায় একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। খিলবাইছার নাটক দেখার জন্য লক্ষীপুর শহর থেকেও শিল্প রসিকগণ চলে আসতেন। খিলবাইছার এই ঐতিহ্যটি এখন আর নেই। তখন খিলবাইছা জিএফ ইউনিয়ন হাই স্কুল ছিল এর কেন্দ্র। আলাবক্স চাচা, আব্বা, বংকিম স্যার (বঙ্কিম বিহারী নাথ), হেদায়েতুল্লাহ হেড্ স্যার, সুজন কাকু, (মরহুম সুজায়েতুল্লাহ ভূঞা), বেলায়েত ভাই, ফিরোজ ভাই, মনসুর ভাই (মরহুম রেজা-ই-রাব্বি), নটু (লুৎফে রাব্বি), ওসমান গনি ভূঞা (কালু), তোফায়েল মাষ্টার প্রমুখ ছিলেন এই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের তৎকালীন বাহক। আমি নিজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম, অভিনয় করেছি, আয়োজন করেছি।
পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর বদু মিয়া কলকাতা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং পৈতৃক বাড়ীতে উঠেন। তাঁর হৃদয়বান দাদা আবদুল করিম নাতির অসহায়ত্বে উদ্বিগ্ন হন। দাদার আগে পিতার মৃত্যু হওয়ায় আমার পিতা পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। একমাত্র নাতির অসহায়ত্ব লক্ষ্য করে তিনি তাঁর সম্পত্তির ৪ আনি অর্থাৎ ২৫% বদিউজ্জামানকে হেবা করে দেন। আজ সেই সম্পত্তিই আমাদের পৈতৃক নিবাস। বদু মিয়ার দুই চাচা ছিলেন। আবদুল করিম তাঁদেরকে ৬ আনি করে সম্পত্তি দেন। এভাবেই বাড়ীর অর্থাৎ আমাদের প্রপিতামহ আবদুল করিমের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হই আমরা ৪ ভাই ১ বোন। আমাদের আরেকটি ভাই মোঃ ফকরুল আমীন শিশু কালেই মারা যায়। আমাদের প্রপিতামহ আরেকটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেন। তিনি তাঁর বৌমা অর্থাৎ আমার দাদীকে নিজ বাড়ীতে নিয়ে আসেন এবং নাতিকে তাঁর কাছে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে ইহকাল ত্যাগ করেন। সম্ভবত; ঐ সময় দাদীর দ্বিতীয় স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন। সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দাদী আব্বার সংগেই ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সময় আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। যাহোক, বাড়ীতে এসে নিজ গ্রামেই আবদুল হক পাটোয়ারীর (পরে হাজী হয়েছেন) মেয়ে জয়তুন্নেছাকে বিবাহ করে সংসার জীবন শুরু করেন। কলকাতায় ছাপাখানায় কাজ করার অভিজ্ঞতার কারণে লক্ষ্মীপুরের ইসলামিয়া প্রেসের ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই প্রেসে ভোটার তালিকা ও ব্যালট পেপার ছাপা হয়। এর মধ্যে কি একটা অনিয়মের কারনে (যেটুকু মনে পড়ে ব্যালট পেপার চুরি হওয়ার কারনে) সরকার বাদী হয়ে ছাপাখানার বিরূদ্ধে মামলা করে। মামলায় আমার পিতা প্রেপ্তার হন। অবশ্য এর পরপরই মামলার রায়ে বেকসুর খালাস পান। উল্লেখ করা যেতে পারে, এই দু:সময়ে যিনি আমার বাবার সংগে রীতিমত যোগাযোগ রাখতেন তিনি আমাদের বাড়ীরই তাঁর মামাতো ভাই নূর মোহাম্মদ ওরপে বেছু, আমাদের “মানিকের বাপ চাচা”। আমার স্পষ্ট মনে আছে যেদিন খালাশ হয়ে চাচার সাথে আব্বা গভীর রাতে বাড়ীতে আসেন চাচা দাদীকে ডাকেন, “ফুফু, মিয়া ভাইকে নিয়ে এসেছি”। কত আনন্দের উচ্চারণ! এই প্রেসে আব্বা আরো কিছুদিন ছিলেন। পরে তৎকালীন আদালতের পাশের টাউন প্রেস ১০আনি-৬আনি শেয়ারে চালানো শুরু করেন। ইসলামিয়া প্রেসটি ছিলো লক্ষ্মীপুর শহরস্থ বড় পুলের দক্ষিণে লাগা লাগা নদীর পাড়ে, আর টাউন প্রেস পুলের উত্তর পাড়ে। এভাবে আরো কিছুদিন যায়। একবার লক্ষ্মীপুর বাজারে আগুন লেগে যায় রাতে। অন্যান্য ঘরের সাথে টাউন প্রেসটিও পুড়ে যায়। প্রেসটির মূল মালিক ছিলেন হারিস চেয়ারম্যানের ভাই মোহাম্মদ মিয়া। তিনি আর প্রেসটি চালাতে চাননি। ভাগ্যের চাকা প্রতিকূল ভেবে আব্বাও এই ব্যবসা ত্যাগ করেন। নূতন পেশা শুরু করেন।
নূতন পেশা শুরু করার আগে গৃহস্থালী এবং চাষাবাদে মনোযোগ দেন। এরই মধ্যে লক্ষ্মীপুর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে দলিল লেখার কাজে যোগ দেন। এব্যপারে আমাদের পশ্চিমের ভূঞা বাড়ীর কুদরত উল্ল্যাহ আমীন (আমাদের আমীন দাদা) তাঁকে সহায়তা দান করেন। তিনি নিজেও আমিনতির পাশাপাশি দলিল লেখক ছিলেন। অল্প দিনের মধ্যেই তিনি দলিল লেখার কাজে দক্ষ হয়ে উঠেন। দলিল লেখা সংক্রান্ত কাজে আশে-পাশের এবং দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আমাদের বাড়ীতে আসতেন। এই কাজে তিনি নিষ্ঠা ও সততার পরিচয় দেন। ফলে তাঁর প্রসার বাড়ে এবং আমৃত্যু এটিই জীবিকার বাহন ছিল। এই পেশায় আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল হয়ে উঠেন। এই কাজের ভবিষ্যৎ ভাল মনে করে তিনি চেয়েছিলেন আমাদের এলাকার কেউ এই পেশায় মনোনিবেশ করুক যে তাঁর পরে এই পেশা চালিয়ে যাবে। অবশেষে পার্বতীনগরের নিমাই চন্দ্র আব্বার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে এবং এখন পর্যন্ত এই কাজে নিয়োজিত আছে। নিমাই আব্বাকে নানা ডাকত আর আমাদের মামা সম্বোধন করত। আব্বার মৃত্যুর পরও নিমাই আমাদের বাড়ী যাবার সংবাদ পেলে চলে আসত। সাব-রেজিষ্টি অফিসে কাজ করার সময় আব্বার নিত্যসংগী ছিলেন আমাদের উত্তরের সোনাপুরের আবদুল লতিফ ভেন্ডার এবং আরেকজন দলিল লেখক নূরুজ্জামান মিয়া। তাঁরা দু’জন আমাদের বাড়ীর সামনে দিয়েই লক্ষ্মীপুর যাওয়া-আসা করতেন বলে আসা-যাওয়া একত্রেই হত। তখনো রিক্সা চালু হয়নি এবং রাস্তা কাঁচা ছিল। শেষ দিকে লক্ষ্মীপুর থেকে খিলবাইছাÑপালেরহাট রিক্সা চালাচল শুরু হলে আব্বা রিক্সায় আসা-যাওয়া করতেন। ততদিনে তাঁর সংগী দু’জন ইহকাল ত্যাগ করেন। খিলবাইছার রিক্সাওয়ালাদের কাছে আব্বা নিয়মিত যাত্রী ছিলেন। তাদেরই একজন এখন শেষ বয়সে অটো চালান। কয়েকদিন আগে (২০ মে ২০২২) মাছিমনগর বাংলা বাজার থেকে আমি এবং সামছুল আমীন আউগানপুরে তার প্রতিষ্ঠিত নূতন জন কবরস্থান দেখতে যাওয়ার কথা বললে ঐখানে থাকা সেই অটোওয়ালা বলেন, “আপনার বাবাকে বহন করেছি, আসুন আজ আপনাদের অটোতে নিয়ে যাই।” আমরা সানন্দে রাজী হই। আমাদের সংগে আবদুল মোতালেব মানিক, আলম, সিরাজ, আরিফ ও পিয়াস ছিল। চলবে.............
সাবেক অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক।