শৈশবে পিতৃবিয়োগ হওয়া এবং মায়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমাদের পিতা বদু মিয়া জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। অনন্যোপায় হয়ে কয়েক বছর পর জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় পাড়ি দেন। ফলে আর উপরের দিকে পড়া-লেখা করতে পারেননি। তাই তিনি তাঁর সন্তানদের শিক্ষার ব্যপারে প্রচ্ছন্ন দৃষ্টিভংগী অবলম্বন করেন। এটির মূল ভিত্তি রচিত হয় কলকাতার শিক্ষা ও সাংস্কৃতির অঙ্গনে তাঁর বিচরণের কারণে। অন্যথায় যদি গ্রামে থাকতেন তাহলে কৃষি নির্ভর জীবন-যাপন করতেন এবং আমাদের ভবিষ্যৎও হয়তো অনুরূপ হতে পারত। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে উন্নত জীবন যাপন করতে বা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই তিনি যথা সময়ে আমাদেরকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। যথাসময়ে মানে সঠিক বয়সেই তা করেন যা গ্রাম্য এলাকায় হয়ে উঠে না, হেলা-ফেলায় দু’একবছর চলে যায়। বিশেষ করে যে সব পরিবার কৃষি নির্ভর তাদের সন্তানরা কখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, কখন পড়া বন্ধ করে দিবে তার নিশ্চয়তা থাকত না। কিন্তু আমাদের পিতা সদা সতর্ক থাকতেন, আমাদের শিক্ষক হিসেবে দেখাশুনা করতেন। বাজার করাতেন না, মূলত: আমাদেরকে বাজারে যেতেও দিতেন না। তিনি বলতেন, বাজারে ভাল জায়গা নয় যেখানে মন্দ লোকদের বেশী আনা-গোনা। ফলে আমাদেরকে পড়ালেখায় নিমজ্জিত থাকতে হত। তিনি নিয়মিত ইত্তেফাক পত্রিকা পড়তেন এবং আমাদেরকে পড়াতেন। ফলে আমরা সবাই ভাল ছাত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছি। ঐ সময়টায় আব্বা প্রেসের কাজ করতেন। আমি যখন এস এস সিতে মানবিক বিভাগে তৎকালীন অবিভক্ত কুমিল্লা বোর্ডে নবম স্থান অধিকার করি (১৯৬৬ সালে), ঢাকা বেড়ানো শেষ করে বাড়ীতে আসি, ঘরের দরজায় আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বাপের ব্যাটা, বাপের মুখ উজ্জল করেছো,”। আমি তাঁকে জানিয়ে দিলাম যে আমি লক্ষ্মীপুর কলেজে পড়ব না। তিনি একমত হলেন, মন্তব্য করলেন যে এখানে পড়লে লুংগি পরে কলেজে যাব, হেঁটে বা সাইকেলে যাব, বাজারের উপর দিয়ে চলাফেরা করব ইত্যাদি নেতিবাচক দিকগুলো। তিনি বলতেন ভালো কলেজে, ভাল পরিবেশে শিক্ষালাভ করলে উচ্চ শিক্ষিত হতে সহজ হবে। আমাকে নিয়ে তিনি কুমিল্লা গেলেন। আমাদের পাশ্ববর্তী গ্রাম সোনাপুর ভূঞা বাড়ীর ইসমাইল সাহেবের ঠাকুর পাড়া বাসায় উঠলেন এবং পরামর্শ করলেন। জনাব ইসমাইল ভূঞা এর আগে আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, আব্বার বন্ধু। আব্বা আমাকে ভিক্টোরিয়া কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মেসবাহুল বার চৌধুরীর (এম বি চৌধুরী) অফিস কক্ষে নিয়ে গেলেন এবং আমাকে ভর্তি করার ইচ্ছে জানালেন। আমি ৯ম স্থান পেয়েছি জেনে অধ্যক্ষ মহোদয় আগ্রহ প্রকাশ করলেন এবং আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। একই সংগে নিউ হোস্টেলে সিট পেলাম। একইভাবে একই ধরণের সিন্ধান্তে নূরুল আমীনকে সিলেট এম সি কলেজে ভর্তি করলেন। এব্যপারে আমাদের গ্রামের খলিল ভূঞা সাহেবের বড় ছেলে আবুল খায়ের ভূঞার আগ্রহেই তা হয়েছে। তিনি তখন সেখানে অর্থাৎ সিলেটে জেলা ইলেকশন অফিসার। ইসমাইল সাহেব চেয়েছিলেন নূরুল আমীনও ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে তাঁর বাসায় থাকুক। কিন্তু আবুল খায়ের ভাইয়ের প্রভাব এবং ভিন্ন একটি ভাল কলেজে পড়ার জন্য নূরুল আমীনের আগ্রহে সে এম সি কলেজেই ভর্তি হল। সামছুল আমীন এস এস সি পাশ করে বায়না ধরল “আমি আরো ভাল কলেজে পড়ব।” সে ভর্তি হল ঢাকা কলেজে। আব্বা প্রত্যেক ক্ষেত্রে আমাদের আগ্রহে সম্মতি দিয়েছেন এবং নিজেও তা ধারণ করতেন। বদরুল আমীন ভর্তি হল চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে। আমি তখন মিলিটারী একাডেমীতে কর্মরত। এভাবে আমাদের উচ্চ শিক্ষার পথ তিনি সুগম করে দিয়েছেন। তাঁর এই দূর-দর্শিতা আমাদের জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে তা আমরা এখন বুঝি। মনে পড়ে ১৯৬৯ কিংবা ১৯৭০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন স্কলারশিপের টাকা থেকে আব্বার জন্য একটি রেডিও কিনি। কেননা, তিনি খবর শুনতে পছন্দ করতেন। এতে তিনি যারপর নাই খুশী হয়েছিলেন এবং সবাইকে জানাতেন। উল্লেখ্য, তখন আমাদের বাড়ীতে বা আশ-পাশের বাড়ীতে কারো রেডিও ছিলনা।
আমাদের ছাত্র জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনি কিছু কৌশল অবলম্বন করতেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে একটি করে চিঠি লিখতেন বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে। তাঁর হাতের লেখা সুন্দর ছিল। আব্বার অন্যুন ৫০টি চিঠির কপি আমাদের কাছে এখনও সংরক্ষিত আছে। এখানে একটি সংযুক্ত করা হল। তিনি আমাকে প্রত্যেক চিঠিতে ডাক নাম “খোকন” সম্মোধন করে লিখতেন। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই তাই। আমরাও রীতিমত লিখতাম। তখনতো মোবাইল, ফেসবুক ইত্যাদি ছিল না। টেলিফোনও সীমিত ছিল। ফলে পত্র যোগাযোগই একমাত্র ব্যবস্থা ছিল খবরা-খবর আদান-প্রদানের। হোস্টেলে টেলিভিশনও ছিল না। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। স্কলারশীপের টাকা প্রতিমাসের পরিবর্তে কয়েক মাসের একত্রে পেতাম। তাই মাঝে মাঝে টাকার জন্য পত্র লিখতাম। তাৎক্ষণিক টাকা না পেয়ে এক সপ্তাহ পর আবার লিখতাম। ৫০ টাকার জন্য লিখলে ৩০ টাকা পাঠাতেন মানি অর্ডার করে। তাতে বিরক্ত হতাম। এর মধ্যে হয়তো অসচ্ছলতাও কাজ করতো। কিন্তু বাড়ীতে গেলে মায়ের জমানো থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসতাম। আব্বা জানতেন, কিন্তু বুঝতে দিতেন না। তিনি চাইতেন যে যা চাই তা দেয়া যাবে না। তাহলে আমরা অপচয় করব। কিন্তু সমস্যা হবে এটা বুঝেই চাইতেন যে তাঁর অগোচরে মায়ের কাছ থেকে প্রয়োজনে টাকা নেই। আমরা যাতে বুঝতে পারি যে টাকা পাওয়া সহজ নয়, তাই হিসেব করে খরচ করতে হবে। মনে আছে, রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশীপ পেতাম মাসে ৪৫ টাকা আর বছরে বই কেনার জন্য ২৫০ টাকা। তাতে অনেকটুকু হয়ে যেতো। কেননা, মেস বিল ছিল ৩১ টাকা আর বেতন ফ্রি ছিল। তিনি বলতেন খাওয়া-দাওয়ায় খরচ করা ভাল, অন্য কিছুতে হিসেব করে চলা ভাল। এছাড়া, আমরা কে কোন্ বিষয় নিয়ে পড়া-লেখা করব এনিয়ে তিনি চাপ প্রয়োগ করতেন না। এস এস সিতে হিউম্যানিটিজ গ্রুপে পাশ করলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য আমাকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে হয়। আব্বা এটি চেয়েছেন, কিন্তু মূল প্রভাবটা প্রয়োগ করেছেন আমার শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক হেদায়েতুল্লাহ স্যার। যাহোক , আই এস সি পাশ করে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হই। তিনি এতে কোন বাধা দেননি। আমার এই বিজ্ঞান অনীহার কারণ ছিল খেলাধূলা পাগল ছিলাম বলে। কলেজ টিমেও খেলেছি, বিশ্ববিদ্যালয় টিমেও খেলেছি। বিকেল বেলা উভয় ক্ষেত্রেই মাঠে কাটাতাম। ছুটিতে এসে খেলাধুলা, নাটক নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম, কোন বাধা ছিল না। আরেকটি বিষয় দেখেছি তিনি প্রতি নামাজান্তে আমাদের জন্য নাম ধরে ধরে দোয়া-মুনাজাত করতেন। ফলে এমন হয়েছে যে তিনি এক টানে এক নিঃশ্বাসে আমাদের এবং তাঁর নাতি-নাতনীদের নাম বলতে পারতেন। আমার মায়ের ক্ষেত্রেও তাই ছিল। স্কুল জীবনে আমাদের পড়ার সময়টা সন্ধ্যারাতে তিনি জেগে থাকতেন। আমরা যখন চার ভাই স্কুলের জীবন শেষ করেছি, সবাই ভাল রেজাল্ট করেছি, এরপর আব্বাকে আফসোস করতে শুনেছি “ইস্ ! যদি প্রতি বছর আমার একটি সন্তান এস এস সি পাশ করত”!
আব্বা যেহেতু অসুস্থতার মধ্যেই দিনাতিপাত করতেন তাই তাঁর সন্তানদের শিক্ষা এবং ভবিষৎ জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি ভাবতেন যে একটি ছেলেও পড়ালেখা শেষ করতে পারল না। তাঁর অবর্তমানে আমাদের কি হবে। এছাড়া, তিনি কিছু বৈরী পরিস্থিতির শিকার ছিলেন। তার মূল কারণ ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা তাঁর সামাজিক অবস্থানের কারণে। এদিকটায় আর যেতে চাই না। তাঁর জীবিতাবস্থায় আমাদের চার ভাইয়ের শিক্ষাজীবন শেষ এবং আমরা চার ভাইই চাকরীতে প্রবেশ করেছি। আমার একমাত্র বোন আয়েশা বেগম আমাদের গ্রামেই নব প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করে আব্বার আগ্রহেই। সেখানে বছরের পর বছর বিনা বেতনে সেবা দিতে হয়েছে। এর অনেক পর খিলবাইছা বালিকা বিদ্যানিকেতনটি এমপিও ভুক্ত হয়। বর্তমানে আয়েশা এই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। আব্বা আমাদের ৫ ভাই-বোনের বিবাহিত জীবন এবং ১০ নাতি-নাতনী পর্যন্ত দেখে গিয়েছেন। একবার আমি তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে তাঁর আর কি চাহিদা আছে বা কি পাওনা বাকী রয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ জানালেন যে আর কোন চাহিদা নেই এবং আল্লাহর নিকট শুকরিয়া প্রকাশ করলেন। তারপর নীচু স্বরে গান ধরলেন, “এ জীবনে যা কিছু চেয়েছি তারো চেয়ে বেশী যেন পেয়েছি।” একটা তৃপ্তি ও মানসিক প্রশান্তি নিয়ে তিনি শেষ জীবন কাটিয়েছেন। জীবনে শেষদিন পর্যন্ত নামাজান্তে আমাদের নাম ধরে দোয়া করতেন আমরা যেন নিরাপদ থাকি। মহান আল্লাহ আজো আমাদের নিরাপদে ও স্বচ্ছল রেখেছেন, আলহামদুলিল্লাহ। তবে আব্বার একটা কাজ অক্ষমতার জন্য সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি হজ্জ করতে পারেনি। আমি পরে তাঁর বদলী হজ্জ করেছি ১৯১৪ সালে। আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠার পেছনে পিতাÑমাতার আদর্শ ও দোয়া প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই আমাদের সব বাবা-মা পরকালে শান্তিতে থাকুন এই প্রার্থনা করি। আমীন।
সাবেক অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক।