আবহমান বাংলার ইতিহাসে হাজারো বৎসরের ঐতিহ্য বহন করে পরিচিতি লাভ করেছিল জামালপুর জেলার ইসলামপুরের কাঁশার শিল্প। জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলায় দরিয়াবাদ গ্রামের এ শিল্পটি একসময় বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে ছিল। নিপুন হাতে তৈরী নান্দনিক সৌন্দর্য মন্ডিত কারুকার্য্য পুর্ণ কাঁশার শিল্পটি ভারত বর্ষে কারখানা গড়ে উঠেছিল। তৎকালিন বৃটিশ সরকার ১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহামে শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করে ছিল। সেই প্রদর্শনীতে জামালপুর জেলার ইসলামপুরের প্রয়াত কাঁশার শিল্পী স্বর্গীয় জগৎচন্দ্র কর্মকার কারুকার্যপূর্ন কাঁশার শিল্পটি প্রদর্শন করে ছিলেন। ওই প্রদর্শনীতে ইসলামপুরের কাঁশার শিল্প সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ^ বিখ্যাত শিল্প হিসাবে স্বর্ন পদক লাভ করে ছিল। সে সময় দিন দিন কাঁশার শিল্পর আরো চাহিদা বেড়ে যায়। তার পর থেকে সারা বিশ্বে কাঁশা শিল্পের পরিচিতি লাভ করায় ভূগোলে স্থান করে নেয় কি এবং কেন বিখ্যাত তার মধ্যে ইসলামপুরের কাঁশার শিল্পটি ছিল একটি।
কালের বিবর্তনে তা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলায় এ মিশ্র ধাতব শিল্পটি কখন কোথায় বিভাবে শুরু হয়েছিল সে সম্পর্কে সুনির্দ্দিষ্ট কোন উল্লে¬খ না থাকলেও অনুসন্ধান করতে গিয়ে শিল্প গবেষনা নৃ বিজ্ঞানীদের মতে ইহা একটি প্রাচীন আমলের সভ্যতা। ওই আমলেও ব্রোঞ্জ শিল্প ছিল। আবার কেউ কেউ একে পাহাড়পুর মহাস্থানগড় সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ততা করতে চান। আবার অনেক অভিজ্ঞ লোকশিল্পীরা এই শিল্পটিকে রামায়ন মহাভারতের যুগে বলে মনে করেন। বংশগত পেশায় কাঁশার শিল্পী প্রয়াত যোগেশ চন্দ্র কর্মকারের পুত্র নারায়ন চন্দ্র কর্মকার এবং কাঁশার শিল্প সমিতির সাধারন সম্পাদক শ্রী অঙ্কন চন্দ্র কর্মকার মনে করেন রামায়ন মহাভারতের জীবন চর্চায় পুজা পারবনে কাঁশার তৈরী ঘটি,বাটি বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহার হতো তাই তারা এ ধারনা পোষন করেন থাকেন। ঐতিহ্য গত ভাবে শিল্পূ ও বোদ্ধা কারিগরের দাবী হিসাবে একে কোনভাবে ফেলে দেওয়া যায় না।
কাঁশা শিল্পীরা তাদের পেশাগত শিল্পজীবন পারিবারিক ভাবে গড়ে তোলার কারণে একই পাড়া/মহল্লায় বসবাস করতেন। তাই তাদের বসবাসকারী এলাকাকে কাঁসারী পাড়া নামে পরিচিতি লাভ করে ছিল। ইতিহাসবিদদের মতে ভারত বর্ষে দেশে সর্ব প্রথম ঢাকার ধামরাই এলাকায় কাঁশার শিল্পী এসে বসতি স্থাপন করে কারখানা গড়ে তোলেন। পরবর্তী কালক্রমে বিভিন্ন কারণে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। ভারত বর্ষে কাঁশা দিয়ে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় শিল্প সামগ্রী তৈরী করে ব্যবহার করে আসছিল বলে সে সময় জটিল কোন রোগ বালাই ছিল না। বর্তমানে টিন,এলোমিনিয়মের ব্যবহারে নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব ঘটেছে বলে দাবী করছেন অভিজ্ঞ প্রবীনরা।
কাঁশা মুলত একটি মিশ্র ধাতব পদার্থ থেকে তৈরী হয়ে থাকে। তামা বা কভার ৮০০ গ্রাম এর সাথে টিনএ্যংগট ২০০ গ্রাম অগ্নিতে দাহ করলে ১ কেজি কাঁশা তৈরী হয়ে থাকে। এ ছাড়া কে কত টুকু তামা, দস্তা,রুপা ও টিনএ্যংগট (রাং) সাথে ধাতব পদার্থ মিশ্রন করবে, তার উপর নির্ভর করবে শিল্পের স্থায়িত্ব, স্বর্”ছতা, মসৃণ ও উজ্জ্বলতা। তবে মিশ্রন জাত প্রক্রিয়ার বিষয়টি একান্ত কারিগর সম্প্রদায়ের উপর অতি গোপনীয়তার বিষয়।
কাঁশার তৈরি বাসন কুশনের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হইলঃ-থালার নামঃÑ কাস্তেশ্বরী,রাজভোগী, রাঁধাকান্তি, বংগী, বেতমুড়ি, চায়নিচ, মালাথাল,দরাজ, রাজেশ্বরী, রতœ বিলাস,ইত্যাদি।
গ্ল¬াসের নামঃÑ গুটা, কলতুলা, সাদাকাঁচের নমুনা যুক্ত গ্লাস, স্বন্দেশ গ্লাস(চার পার্ট) ১ম পার্টে পানি, ২য় পার্টে মিষ্টি, ৩য় পাটে পানসুপারী, এবং ৪র্থ পার্টে পান মসলা।
জগের নামঃÑকৃষ্ণচুড়া, ময়ুরকন্ঠি, বকঠুট, ময়ুর আঁধার, মল্লিকা ইত্যাদি।
বাটির নামঃÑ সাদাবাটি, কাংরিবাঠি, বোলবাটি, রাজভোগী, রাঁধেশ্বরী, জল তরঙ্গ, রামভোগী, গোলবাটি, কাজল বাটি, ঝিনাই বাটি, ফুলতুলি বাটি, মালা বাটি,
চামচের নামঃÑবোয়াল মুখী, হাতা, চন্দ্রমুখী, চাপিলা মুখি, পদ্মা মুখি, কবুতর বুটি, ঝিনাই মুখী ইত্যাদি দ্রব্যদির বাহিরে রয়েছে অনেক। এ ছাড়া পূজা অর্চনায় মঙ্গল প্রদীপ ,কোসাকুর্ষি, মঙ্গলঘট, কাঁসার বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি রয়েছে।
এ বিষয়ে কারখানার মালিক উত্তম কুমার কর্মকার বলেন,শিল্পটি বাঁচিয়ে রাখতে মসলিম শিল্পের মত সরকারী সাহার্য্য সহযোগিতার একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে টিন এ্যাংগট (রাং) মালেশিয়া থেকে কাঁচা মাল আমদানি করতে হয়। পাশাপাশি স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋনের ব্যবস্থা করে উৎপাদিত কাঁশার পণ্য বহিরবিশ্বে বাজারজাত করণ করতে হবে। শিল্পীবোদ্ধা লাল মিয়া,শরিফ উদ্দিন,সাহেব আলী,অবিজল এনামুল হক বলেন,উৎপাদিত পণ্য কম বিক্রির কারণে কারখানার মালিকগণ স্বল্প সংখ্যাক পণ্য তৈরি করে থাকেন। তাই আমাদের দৈনিক ৫শ টাকার বেতনে পোষে না।
ইসলামপুরের কাঁসার শিল্প সমিতির সভাপতি নারায়নচন্দ্র কর্মকার,সাধারণ সম্পাদক অঙ্কনচন্দ্র কর্মকার জানান, তাদের বংশগত ঐতিহ্য এবং পেশাগত দিক থেকে এই শিল্পটি ধরে রেখেছেন। পূর্বে কভার বা তামা এবং টিংএ্যংগটের মূল্য কম থাকায় তৈরী খরচ ছিল তুলনা মূলক কম। তাই তাদের বাজার জাত করে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে ক্রেতাদের উদ্ববোদ্ব করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে তামার দাম অত্যধিক বেশী তার সাথে টিনএ্যংগটের মূল্য ২শ টাকার স্থলে সাড়ে ৩ হাজার টাকা থেকে ৪হাজার টাকা কেজি দরে ক্রয় করায় তৈরী খরচ অত্যধিক বেশী হয়ে থাকে। কেননা সরকারী ভাবে টিনএ্যংগট মালোশিয়াতে আমদানি না থাকায় ২শ টাকার কেজি টিনএ্যংগট বর্তমান বাজারে সাড়ে ৪ হাজার টাকা কেজি ক্রয় করতে হয়। এ কারণে ৮ গ্রাম তামা(কভার) ১ হাজার টাকা ২শ গ্রাম টিনএ্যংগট প্রায় ৮শ টাকা এবং কারিগর খরচ ৫শত টাক। তাই ১কেজি কাঁসা তৈরী খরচ পড়ে তাদের প্রায় ১৮শ টাকা কারিগর মজুরী ৫শ টাকা সর্বমোট ২হাজার ৩শ টাকা খরচ হয়ে থাকে। বিক্রয় করতে হয় ২ হাজার ৫শ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা। প্লাষ্টিক-মেলামাইন তৌজষপত্রের ভীরে ক্রেতারা উচ্চমূল্যে কাঁশার তৌজষপত্র খরিদ করতে চায়না। এ কারণে কারিগর/শিল্পীদের সঠিক ভাবে বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই তাদের বর্তমানে দুর্দিন চলছে। অনেকেই বাঁচার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ শিল্পটিও মসলিন শিল্পের মতো বিলিন হয়ে যাবে। শিল্প সংশি¬ষ্টদের আবেদন,মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যেন মুসলিম শিল্পের রক্ষার মত ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পটি ধরে রাখার স্বার্থে সরকারী উদ্যোগে মালেশিয়া থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ টিনএ্যংগট আমদানি করে কম দামে বিক্রয় করার ব্যবস্থা নেন,পাশাপাশি এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্তদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদান করে শিল্প সংশি¬ষ্টদের উদ্ববোদ্ধ করে দেশে-বিদেশে শিল্প মেলার আয়োজন করে চাহিদা বৃদ্ধি করা হলে শিল্পটি ধরে রাখা সম্ভব হবে। নচেৎ কালের বিবর্তনে একসময় শিল্পটি বিলুপ্তি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য বর্তমানে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী আলহাজ ফরিদুল হক খান দুলাল তিনি বলেন,বিশ্ব খ্যাত কাঁশার শিল্প প্রসার ঘটাতে আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ কাঁচামাল আমদানি করার ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের বিবেচনায় আনা হলে শিল্পটি বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পাবে বলে জানিয়েছেন।