সরকারি কর্মজীবন থেকে অবসরে যাওয়া দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিক, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম (৭০)। বসবাস করেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার একটি গ্রামে। সেরে নিচ্ছেন জায়গাজমি ভাগবণ্টনসহ অন্যান্য কাজ। মোবাইল ফোনে কথা বলতেই আনন্দে আত্মহারা এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জানালেন, প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন জমি সংক্রান্ত শুনানির জন্য পৈত্রিক ঠিকানা দৌলতপুর উপজেলা ভূমি অফিসে যাওয়ার। দীর্ঘ এই পথে তাকে চলতে হবে বাস, ইজিবাইক অথবা ব্যাটারিচালিত পাখি ভ্যানে। এরইমধ্যে আবদুল করিম জানতে পারলেন, দৌলতপুর ভূমি অফিস তাকে সেবা দিতে পারবে উপজেলার যে কোনো তহসিল অফিস থেকেই। এ ক্ষেত্রে তার পথ কমে গেল অর্ধেকেরও বেশি।
বাড়ির কাছাকাছি দূরত্বের সংশ্লিষ্ট তহসিল অফিসে হাজির হওয়া আবদুল করিমকে আগে থেকে জানিয়ে দেয়া শুনানির নির্দিষ্ট সময়েই সংযুক্ত করা হলো অনলাইন ভিডিও কনফারেন্সে। একদিকে সেবাগ্রহীতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম অন্যদিকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আফরোজ শাহীন খসরু। এসিল্যান্ডের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেই তিনি ভূমি সংক্রান্ত খুঁটিনাটি সব তথ্য ও কাক্সিক্ষত সেবা পেয়ে গেলেন। শুধু আবদুল করিমই নন, তার মতো দৌলতপুরের হাড়াভাঙ্গার গোলেজান নেছা, আবদুল হামিদসহ আরো অনেকেই জানান, বর্তমানে তারা নিজেদের ভূমি সস্পর্কিত বিভিন্ন কাজ সেরে নিচ্ছেন ডিজিটাল সেবার সময়োপযোগী এই সহজ পদ্ধতিতে। ভূমিসেবা পেতে তাদের আর আগের মতো বেগ পেতে হচ্ছে না।
উপজেলা ভূমি অফিসে দালাল চক্রের আনাগোনা দেখা গেলেও মোটেও সুবিধা করতে পারছে না তারা। এ ছাড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোও এখন অনেকাংশে দালালমুক্ত রয়েছে। ফলে কমে গেছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা দুর্নীতির মাত্রাও। একসময় জমি খারিজ বা নামজারির জন্য সাধারণ মানুষকে ঘুরতে হতো মাসের পর মাস। এখন দশ দিন থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যেই মিলছে এই সমস্যার সমাধান। এর আগে কাগজ জমা দেয়ার ২৮ দিন পরে জানা যেত, কোনো কাগজে সমস্যা এবং তথ্য ঘাটতি আছে কিনা। আর এসব বিষয়ে এখন আবেদন করার দিনেই যাচাই বাছাই করে বিস্তারিত জানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে জেলার বিশাল আয়তনের সীমান্তবর্তী উপজেলা দৌলতপুরে ভূমি উন্নয়ন কর এখন শতভাগ আদায় হচ্ছে অনলাইনেই। এ উপজেলায় গেল অর্থবছরে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বাড়তি আদায় হয়েছে আরো প্রায় ৫০ লাখ টাকা। গত এক বছরে খাস জমি উদ্ধার ও শনাক্ত হয়েছে প্রায় ৮ একর। যার সরকার নির্ধারিত বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৭ কোটি টাকা। উদ্ধারে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো বেশকিছু খাস জমি। এগুলো সম্ভব হয়েছে এক বছর আগে এ উপজেলায় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দায়িত্ব গ্রহণকারী আফরোজ শাহীন খসরুর আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে।
শুরুতেই এসিল্যান্ড আফরোজ শাহীন খসরু ডিজিটাল ভূমিসেবার বিষয়ে মানুষকে অবগত করতে পোস্টারিং, মাইকিং আর লিফলেট বিতরণ কার্যক্রম চালান মাসব্যাপী। উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোর সাথে সার্বিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা জোরদার, অনিয়ম প্রতিরোধের লক্ষে বসানো হয় ভিডিও কনফারেন্স কমিউনিকেশন সিস্টেম ও অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা। সর্বশেষ উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল ও দূরবর্তী এলাকার মানুষের ভোগান্তি লাঘবে নতুন অর্থ বছরের শুরুতে অনলাইনে মিসকেসের শুনানি গ্রহণ শুরু করেন এই এসিল্যান্ড। পরবর্তীতে অনলাইনে মিউটেশন শুনানির কার্যক্রম শুরু করার কথাও জানানো হয়েছে। এসব ডিজিটাল কার্যক্রম সেবাগ্রহীতাদের জন্য দারুণ সুবিধাজনক হয়ে উঠেছে। পদ্মা-হিসনায় বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন বাস্তবায়নে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি এসিল্যান্ড কড়া নজর রাখছেন ভোক্তা অধিকার ও বাল্যবিবাহেও।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জমিজমা সংক্রান্ত সেবাগ্রহণকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিজিটাল ভূমিসেবা গ্রহণের ফলে সময় আর বাড়তি খরচ দুটোই বেঁচে যাচ্ছে তাদের। দেশের বিভিন্ন উপজেলায় এ ধরনের ডিজিটালাইজেশন প্রকল্প চালু করা হয়েছে। যার আওতায় দৌলতপুর উপজেলা না থাকলেও এই কার্যালয়টি দিতে সক্ষম হয়েছে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল সেবা। সার্বিকভাবে ডিজিটাল ভূমিসোয় এখানকার মানুষের আস্থা দিন দিন বাড়ছে। যার কারিগর হিসেবে সমাদৃত এসিল্যান্ড আফরোজ শাহীন খসরু।
৬৮তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মেধাবী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, ‘দৌলতপুর উপজেলা কাজ করার জন্য চমৎকার একটি প্লাটফর্ম। গত এক বছরে বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্লেষণের মাধ্যমে বেশকিছু পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে। সেবাগ্রহীতারা ডিজিটাল সেবাগ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। আগামী দিনগুলোতে সবধরনের কাজ আরো গতিশীল হবে বলে প্রত্যাশা রাখছি।’