গণঅভ্যুত্থানে উত্তাল দ্বীপ দেশ শ্রীলংকা। শ্রীলংকাকে এখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বলা যায়। সব সূচকেই শ্রীলংকা এখন অস্বাভাবিক অবস্থানে বা তলানীতে নেমে এসেছে। অর্থনৈতিকভাবে দেশটি দেউলিয়া। বিদ্যুৎ, জ্বালানী, জরুরী ঔষধ, খাদ্য সামগ্রীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র অভাব, ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা, সবকিছু মিলিয়ে শ্রীলংকার জনজীবন বিপন্ন। ওদিকে, রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশটিকে অচল করে দিয়েছে।পূন:পূন: র্কাফু ও জরুরী অবস্থা, সরকার পরিবর্তন, প্রেসিডেন্ট- প্রধান মন্ত্রীর তোপের মুখে পলায়ন, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী ও সরকারী মন্ত্রী-এমপিদের বাড়ী ভংচুর-দখল এসবে টাল-মাটাল শ্রীলংকা। বলা যায়, আপাতত: বিক্ষোভের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে ৯ জুলাই ২০২২ আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে টেক্কা দিয়ে বিক্ষোভকারীরা যখন প্রেসিডেন্ট ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন দখল করে নেয়। তাদের উল্লাস ও তান্ডব ধ্বংশাত্মক রূপ নেয়। কিছু সময়ের জন্য ঐ দুটি ভবন ও চত্বর যেন গণসম্পত্তি ও দর্শনীয় পার্কের রূপ ধারণ করে। বিক্ষোভকারীরা ইচ্ছেমত ব্যবহার করে ওই দুটি বাসভবন। আগুন ধরিয়ে দেয় প্রধান মন্ত্রীর সরকারী ও ব্যক্তিগত বাড়ীতে। ফলে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাক্ষে পলায়ন করেন পেছনের দরজা দিয়ে। বিমান বন্দর ও নৌবাহিনীর জাহাজে পালাতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে সেনা বাহিনীর বিমানে করে মালদ্বীপ পৌঁছেন। এরপর সিংগাপুর। সেখান থেকে পদত্যাগ পত্র পাঠান। আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় হয়। সংক্ষিপ্ত বিরতি ঘটে বিক্ষোভের। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা রাজপথ ছাড়েনি। তারা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের বিদায়ও চায়। এরই মধ্যে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। আবার ২০ জুলাইয়ের পার্লামেন্টের ভোটে গোতাবায়ার দলের সমর্থনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি কঠোর অবস্থানে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন এবং বিরোধীদের দমনে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেছেন। এতে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। বরং এতে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়া হল। এখন হয়তো অপেক্ষা ২য় দফা বিক্ষোভে তাঁর বিদায় নিশ্চিত করার।
শ্রীলংকায় এই বিক্ষোভের সূচনা হয় ২০২১ সালের এপ্রিলে যখন কৃষক শ্রেণী বিক্ষোভ করে জৈব সার আমদানী ও ব্যবহার বন্ধ করে দেয় সরকার। শুধু অরগানিক সার ব্যবহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল আমদানীতে অর্থ সাশ্রয়। কিন্তু তাতে কৃষি উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পেয়ে কৃষককূল নিঃস্ব হয়ে যায় এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। যদিও পরে এই নির্দেশ বাতিল করা হয়, ততদিনে যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। করোনার ছোবল ও ইউক্রেন যুদ্ধে দ্বিতীয় আঘাত আসে শ্রীলংকার পর্যটন খাতে। বৈদেশিক রেমিটেন্সও কমে যায়। শুরু হয় শ্রীলংকার অর্থ মন্দা, বৈদেশিক রিজার্ভের অস্বাভাবিক হ্রাস, খাদ্য ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, জরুরী ঔষধ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রির তীব্র অভাব, জ্বালানী ও বিদ্যুৎ সংকট যার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা বন্ধ রাখতে হয়। আমদানী করার সামর্থ হারিয়ে ফেলে শ্রীলংকা। জনজীবনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। মার্চ ২০২২ থেকে শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। অর্থনৈতিক ইস্যু নিয়ে আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু হলেও এটি রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। জনরোষ পড়ে দুই দশক ধরে কর্তৃত্ববাদী শাসক গোষ্ঠী রাজাপক্ষে পরিবারের উপর। তাদের একনায়কত্ব, দূর্নীতি, সজনপ্রীতি ও দুঃশাসনের জন্য এসব হয়েছে বলে অভিযোগ রিরোধী দল ও জনগণের। একই পরিবারের অন্তত: সাতজন সরকারের দায়িত্বে ছিলেনÑপ্রেসিডেন্ট গোতাবায়া, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ্রা, ছেলে যোশিথ, ভাই বাসিল ও চমল এবং চমলের ছেলে নমল ও সশীন্দ্র। সবাই রাজাপক্ষে পরিবারের। সবাই মন্ত্রীত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। ১৩ জুলাইয়ের পর আর রাজাপক্ষের কেউই নেই দৃশ্যপটে। গোতাবায়া এবং বাসিল ছাড়া আর কেউ দেশ ত্যাগ করতে পারেননি। অথচ এই গোতাবায়াই তিন দশকের তামিল টাইগারদের বিদ্রোহ নিষ্ঠুরভাবে দমন করে হিরো বনে যান এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করে সরকার পরিচালনা করেন। নিজেদের কর্মফলে দু’বছর না যেতেই আজ তাঁরা অবাঞ্চিত।
রাজাপাক্ষ পরিবারের বিদায় নিশ্চিত হলেও আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে এই কথা বলা যায় না। কারণ নাটকের নূতন দৃশ্য মঞ্চায়িত হয়েছে নূতন সরকার গঠনের মাধ্যমে, রাজাপাক্ষ পরিবার সমর্থিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ইউ নাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে। এর আগে তিনি ছয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। অথচ সংসদে তাঁর মাত্র একটি আসন। গোতাবায়াই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন যদিও এর আগে তাঁরা রাজনৈতিক শত্রু ছিলেন। ওদিকে নূতন প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন গোতাবায়া রাজাপক্ষেদের দল পদুজানা পেরামুনার সাংসদ রনিলের স্কুলের সহপাঠী দীনেশ গুনাবর্ধনে। মন্ত্রীসভারও শপথ করানো হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের মূল ও প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল গোতাবায়াÑ মাহিন্দাসহ পূরো রাজাপাক্ষ পরিবারের উৎখাত। তা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের দল এখন ক্ষমতায়, প্রেসিডেন্ট রনিল তাঁদের ঘনিষ্ট, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের দলনেতা, পার্লামেন্টে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, মন্ত্রীসভায় তাঁদেরই লোক। তাঁদের ছায়াই এখন সরকারে। এখানেই বিপত্তি। শুরু থেকেই বিক্ষোভকারীরা বলে আসছিল রনিল গোতাবায়ার “ভাঁড়” ও রাজাপক্ষে পরিবারের এজেন্ট, তাঁকে তারা প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও চায়নি, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবেও না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় সে দাবীতো আরো জোরদারই হবে। রাজাপাক্ষদের দলের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রীসভাকে কিভাবে রিরোধীরা মেনে নিবে ? তাহলে আন্দোলনের স্বার্থকতা কোথায় ? “যেই কপাল সেই মাথা।” এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে এবং বিক্ষোভ একটি নূতন মাত্রা পাবে। অথচ রনিল বিক্রমাসিংহে এবং নূতন সরকার সাংবিধানিকভাবে বৈধ, কিন্তু অবাঞ্চিত। বিশ্ব রাজনীতিতে এটি বিরল। যাদের বিরূদ্ধে এই প্রচন্ড “আরাগালায়া” (সিংহলী ভাষায় এর অর্থ আন্দোলন Ñ সংগ্রাম Ñ বিক্ষোভ) তাদের ঘনিষ্ট বা পক্ষীয় লোকরাই এখন ক্ষমতায়। রনিলের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট হওয়াকে অনেকে হাস্যকর বা গণতন্ত্রের সাথে মশকরা বলেছেন। যে লোকটি বিতর্কিত, সংসদে প্রতিনিধিত্বহীন এবং জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত তিনিই কিনা সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। বিরোধীরা এখন এই সরকার, সংসদ এবং সংবিধান সংশোধন দাবী করছে। এটিই বোধ হয় সমাধানের একটি পথ। একটি কর্তৃত্ববাদী পরিবার ও সরকার দেশটাকে রসাতলে নিয়ে গেছে যার বিরূদ্ধে এই অভ্যুত্থান যেটি দোর্দন্ত প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে পালাতে বাধ্য করতে পেরেছে সেটি এত সহজে থেমে যাবে এটি আশা করা যায়না। শ্রীলংকার তরুণরা এবং বিরোধী জনগণ শত নিপীড়ন সত্বেও যে সফল বিক্ষোভ করেছে তার সুফল আসবে বলেই আশা করা যায়।
বিক্ষোভকারীদের প্রত্যাখ্যাত ব্যক্তি রণিল বিক্রমাসিংহে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হলেন তার একটা সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি টানা প্রয়োজন অনুভুত হচ্ছে। তিনি রাজাপক্ষেদের বিরোধী শিবিরেই ছিলেন আন্দোলনের শুরুতে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার সাথে তাঁর একটা সমঝোতা হয় এবং তাই তাঁকে গোতাবায়া তাঁর বড়ভাই মাহিন্দার বিদায়ের পর প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন যার পালামেন্টে ২২৫ আসনের মধ্যে একটি মাত্র আসন রয়েছে। এরপর গোতাবায়া পালালে এবং পদত্যাগপত্র প্রেরণ করলে সাংবিধানিকভাবে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন ১৪ জুলাই ২০২২। ২০ জুলাই পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হন গোতাবায়াদের সমর্থনের আশায়। অথচ গোতাবায়ার দল এসএলপিপি নেতা সাংসদ দুল্লাস আলাহাপেরুমাও প্রার্থী হন। অন্যদের সমর্থন নিয়ে তিনি পান ৮২ ভোট। অথচ তাঁর দলই ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) রনিলকে ১৩৪ ভোট দেয়। এটিই অদ্ভুত ঘটনা এবং বিব্রতকর। শ্রীলংকা পদুজানা পেরামুনা বা এসএল পিপি-এর কেউ বা তাদের ভোটে কেউ নির্বাচিত হোক এটা বিরোধীরা চায়নি। কিন্তু তাই হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল সামগ্রী জানা বালাওয়েগার বা ইউনাইটেড পিপলস পার্টির নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা (সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে) প্রার্থী হলেও সংসদে আসন কম হওয়ায় (৫০) প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন যাতে রনিল প্রেসিডেন্ট না হতে পারেন। বামপন্থী জনতা বিমুক্তি (জিভিপি) নেতা অনুঢ়া কুমারা দিশানায়েকেও প্রার্থী হয়েছেন, ভোট পেয়েছেন ৩টি। এই দলটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে পরিচিত। রনিলের বিরূদ্ধে তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স বা এসএলপিপির দুল্লাসকে সমর্থন দিয়েছে। যেহেতু সংসদে এসএলপিপি সংখ্যা গরিষ্ঠ এবং গোটাবায়ার নির্দেশে তারা রনিলকে ভোট দিয়েছে নিজ দলের প্রার্থীর পরিবর্তে তাই রনিলের প্রেসিডেন্ট পদ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু এর ফল কি ভাল হবে ?
রনিল বিক্রমাসিংহে যতই বিতর্কিত হোক বা বিরোধীদের অপছন্দের হোক তিনি এখন শ্রীলংকার বৈধ প্রেসিডেন্ট। ২০ জুলাই পার্লামেন্টের ভোটে তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়েছেন। কিন্তু এটাকে অনেকে হাস্যকর মনে করেন। এখানেই রাজনৈতিক থিওরি বা দর্শনের সাথে মাঠের রাজনীতির সংঘাত। যার কোন জনসমর্থন নেই, পালামেন্টে ২২৫ আসনের মধ্যে তাঁর মাত্র একটি আসন, যার বিরূদ্ধে অর্থাৎ তাঁকে বিদায় করার জন্য আন্দোলনকারীরা খড়গহস্ত তিনিই কিনা পদ্ধতি বা আইনের বলে এক সপ্তাহের মধ্যে হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী, হঠাৎ করে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এবং শেষে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সিংহলীদের সমর্থন এবং সেনা ও পুলিশ বাহিনীতে সমর্থন থাকা সত্বেও বিপ্লবী আন্দোলনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াকে পালিয়ে বিদায় নিতে হল সেখানে তাঁদেরই ঘনিষ্ঠ ও স্বার্থরক্ষাকারী রনিল প্রেসিডেন্ট, আবার রাজাপক্ষেদের দল এসএলপিপি-র নেতা দীনেশ গুনাবর্ধনে হলেন প্রধানমন্ত্রী। আরো লক্ষণীয় যে এই দলের নিজস্ব প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দুল্লাশকে ভোট না দিয়ে সাংসদরা আরেক দলের প্রার্থী অর্থাৎ এউএনপির রনিলকে ভোট দেয়। এটি শুধু হাস্যকর নয়, জনগণ এবং আন্দোলনের প্রতি বৃদ্ধাংগুলি প্রদর্শন। বাস্তব বলছে এক, পদ্ধতি বা আইন বলছে আরেক। পার্লামেন্ট বা আইন সভার সদস্যরা যারা জনগনের ভোটে নির্বাচিত তারা জনগণের আকাংখা বা চাহিদার বিরূদ্ধে কাজ করছেন। মূলতঃ এখন তারাই অবৈধ বলা যায়। সেই অবৈধরাই রনিলকে জনচাহিদার বিরূদ্ধে ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। এখন কি হবে ? বিরোধী বা বিক্ষোভকারীরা যেভাবে মাহিন্দা গোতাবায়াকে বিদায় করেছে সেভাবেই রনিলকেও বিদায় করেবে এটিই এখন বাস্তব। ইতোমধ্যে আন্দোলনকারীরা তা ঘোষণা করেছে। তারা শেষ দেখে ছাড়বে বলেই বিশ্বাস। এদিকে চাচা জয়বর্ধনে এবং রনিলের নিজের দীর্ঘদিনের খায়েস প্রেসিডেন্ট হওয়া বাস্তবে রূপ লাভ করায় এখন তিনি ক্ষমতাবান হয়ে আন্দোলন দমনের ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশ নামিয়ে ধর- পাকড় শুরু করেছেন। এটিকেই তিনি শান্তি ফিরিয়ে আনার সঠিক পথ বলে মনে করেছেন। কিন্তু তাঁকে তাঁর পূর্বসূরীদের পরিনামও ভেবে দেখতে হবে।
এই মুহূর্তে শ্রীংলকার রাজনীতি জটিল হয়ে পড়েছে। একই সংগে পরিস্থিতি উত্তপ্ত। এই আন্দোলনে বহুমত ও বহু মতাদর্শে বিশ্বাসীরা যুক্ত হয়ে যার যার মত করে এগুতে চেষ্টা করছে। এখানে ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী এবং ছাত্র Ñ তরুণরা সংশ্লিষ্ট। গোতাবায়ার এসএলপিপি বা পদুজানা পেরামুনা দল এখন সরকারে যারা উগ্র সিংহলী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই এই জাতীয়তাবাদ সংখ্যালুদের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে দেখছে এবং তারা সরকারী চাকরী ও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের স্বীকার। দশভাগ মুসলমান ও পনেরভাগ তামিলদের দমনÑ নিপীড়নে গোতাবায়ারা হাত রঞ্জিত করেছেন। জন্ম দিয়েছেন বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারতের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের মত উগ্র বৌদ্ধ সিংহলী জাতিয়তাবাদের। শুরুতে নাগরিক অধিকার ও স্বায়ত্বশাসনের দাবী থেকে এগিয়ে স্বাধীনতার দাবীতে তামিল টাইগারা সশস্ত্র বিদ্রোহে লিপ্ত হয়। এই বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে এই জাতীয়তাবাদ আরো শক্তিশালী হয় এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে গোতাবায় বিপুলভাবে জয়ী হন এবং ক্ষমতা দখল করেন যদিও শেষ রক্ষা হয়নি। এসএলপিপির পাশাপাশি প্রায় একই আদর্শের দল সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সাজিথ প্রেমাদাসার রয়েছে এস জে বি বা সামগী জানা বালাওয়েগা দল। এটি একটি প্রধান বিরোধী দল। এরা পরিবর্তন চায় সাংবিধানিকভাবে। বামপন্থী দলের মধ্যে রয়েছে জেভিপি বা জনতা বিমুক্তি পেরামুনা, এফএসপি বা ফ্রন্ট লাইন সোসালিস্ট পার্টি। এদের সাংগঠনিক তৎপরতা মজবুত এবং বিপ্লবী আদর্শে বিশ্বাসী। জেভিপি ইতোপূর্বে দুবার সশস্ত্র অভ্যুত্থ্যানের চেষ্টা করেছে এবং অনেক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ছিল। এদের ছাত্র সংগঠনও শক্তিশালী। এছাড়া রয়েছে রনিলের ইউএনপি বা ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি যারা মধ্যপন্থী এবং তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স বা টিএনও। এই আন্দোলনের ছাত্রÑতরুণদের সক্রিয় সংগঠন আন্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা আই ইউ এস ইউ এস এল যার আহবায়ক ওয়াসান্থা মুদালিগে। এদের সবার সম্মিলিত আন্দোলনের ফসল রাজাপাক্ষদের বিদায়। এই বিক্ষোভে এসব ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের দলগুলো নিজেদের মত করে ফসল নিতে চাইছে। কেউ ক্ষমতার বদল, কেউ সংবিধানের আমূল পরিবর্তন, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির অবসান, সমাজতান্ত্রিক সংস্কার এসব ভিন্নপথে সমাধান চাইছে। তাই বিপ্লবের সাথে প্রতি বিপ্লবেরও ঘটনা ঘটছে।
শ্রীলংকার বর্তমান পরিস্থিতি এবং অস্থিরতার শেষ কিভাবে হবে তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। বর্তমান বিক্ষোভ আন্দোলনের ধারা দেখে তীব্র বিক্ষোভ বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট রনিলের বিদায়ের সম্ভাবনাই বেশী মনে হয়। তিনি সাংবিধানিক ভাবেও ভালোর ভালোয় বিদায় নিতে পারেন সংসদ ভেংগে দিয়ে তত্বাবধায়ক বা সর্বদলীয় অস্থায়ী বা অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে। অন্যথায় তৃতীয় কোন শক্তিও ক্ষমতায় এসে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তবে রনিল একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক এবং ধূর্ত। তাঁর চাচা সাবেক প্রেসিডেন্ট জয়বধনেও ধূর্ততার সাথে ১২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন এবং “ওল্ড ফক্স” (ঙষফ ঋড়ী) বা বুড়ো শিয়াল বলে অভিহিত ছিলেন। রনিল নাকি তারো চেয়ে ধূর্ত। তাঁর প্রমান তাঁর নাটকীয় উত্থান। তিনি কিভাবে এই অবস্থায় উত্তরণ ঘটাবেন Ñ সরল পথে না বাঁকা পথে তা দেখার বিষয়। ইতোমধ্যে তিনি কঠোর অবস্থানে রয়েছেন এবং আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ও গলসী ফেস থেকে বিক্ষোভকারীদের হটিয়েছেন সেনাÑপুলিশের মাধ্যমে। এভাবে তিনি শেষ রক্ষা করতে পারবেন কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া, অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব, বিদ্যুৎ এবং খাদ্য Ñ জ্বালানীর তীব্র সংকট থেকে কিভাবে দেশটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে তাও একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। রনিল পশ্চিমা ঘেঁষা হওয়ায় আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক এবং উন্নত দেশগুলোর সাথে দেনÑদরবারে কিছুটা সুবিধা পাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক বা সরকারের স্থিতিশীলতা না থাকলে কেউই পরিপূর্ণ সহায়তায় এগিয়ে আসবে না। আর সেজন্য অপেক্ষাও করতে হবে। সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলে জনগণ ও বিরোধীদের এক কাতারে না আনতে পারলে শ্রীলংকার শান্তি ও স্বস্তি আসবে না। সেজন্য দৃষ্টিভংগীর বদল প্রয়োজন। সংখ্যালঘু ও বিরোধীদের প্রতি গণতান্ত্রিক ও নিরপেক্ষ আচরণ এই ঐক্যের জন্য প্রয়োজন। রনিলের কঠোর দমননীতির বিরূদ্ধে মানবাধিকার কমিশন ও বিভিন্ন দেশ সোচ্চার হয়েছে। উদার নীতির মাধ্যমে এটিরও প্রশমন হওয়া প্রয়োজন। প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে যদি এসবের তোয়াক্কা না করে সেনা Ñ পুলিশের মাধ্যমে দমননীতি অব্যাহত রাখেন তবে এর পরিনতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। শ্রীলংকায় সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। আবার উন্নয়নশীল দেশটি ঐতিহ্যে ফিরে আসুক এবং জনগণ শান্তি ও স্বস্তিতে জীবন যাপন করুক এটিই সবার প্রত্যাশা।
সাবেক অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক