গাজীপুরের টঙ্গীতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। পশ্চিম থানার ৫১, ৫২, ৫৩, ৫৪ ও ৫৫নং ওয়ার্ডের বিভিন্নস্থানে ভিন্নভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। মাদক ব্যবসা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, অস্ত্র ঠেকিয়ে সাধারণ মানুষের টাকা কেড়ে নেয়া, স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, চাঁদাবাজি, বেপরোয়া গতিতে মোটর সাইকেল চালানো, উচ্চশব্দে হর্ণ বাজিয়ে এলাকায় মহড়া দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং চাঁদাবাজির মতো নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাং-এর এসব সদস্যরা। তাদের বিরুদ্ধে থানায় রয়েছে একাধিক মামলা ও অভিযোগ। এদের অপতৎপরতায় এলাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়-য়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা উদ্বেগের সাথে দিন কাটাচ্ছেন। এসব অপকালচার প্রতিরোধে আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানালেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসীরা জানান, পশ্চিম থানা এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে কিশোর গ্যাং সদস্যরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় এদের উৎপাত উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিটি করপোরেশনের ৫১ নং ওয়ার্ডে সাতাইশ লস্কর পাড়ায় ফয়সাল, জয়নালের ছেলে রিফাত, ধরপাড়ার রুবেল, অপু, সাতাইশ চৌরাস্তার সিফাত, মুজাহিদ, সজল, রাব্বি, রফিক, জোনাব আলীর ছেলে কাজিম, রেজা সিকদারের ছেলে অমি, রফিক পাগলা ওরফে সাধু ও কছিমউদ্দিনের ছেলে পাগলা মনিরের নেতৃত্বে সাতাইশ চৌরাস্তা, রাজনগর, বাগানবাড়ি, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রোড, ছায়াকুঞ্জ আবাসিক প্রকল্প, সাতাইশ-তিলারগাতী রোড, তিলারগাতি-খাঁ-পাড়া রোড এলাকায় নিয়মিত মহড়া দিয়ে থাকে। দলবেঁধে মাদক সেবন, মাদক বিক্রি, স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, ছিনতাইসহ নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত এরা। গত ২৫ জুলাই দুপুরে মাদক বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় সাতাইশ চৌরাস্তা লস্কর পাড়ায় বিল্লাল হোসেন নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাত করে আহত করে কিশোর গ্যাং এর সদস্য ফয়সাল, সুজন, হিমেল। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকার পোশাককর্মীসহ যুবসমাজ।
৫২নং ওয়ার্ডের দারাইল এলাকায় আবু তালেব, সুমন, আয়েত আলী, রতন ও তাহের এবং ভাদাম এলাকায় আমিন, আজিজুল, সাকিব, আরিফ, অটোচালক হৃদয়ের নেতৃত্বে একটি কিশোর গ্যাং পরিচালিত হচ্ছে। এ গ্যাং-এর সদস্যরা দারাইল, তিলারগাতি, গুশুলিয়া, গুটিয়া, আন্দারুল, বাকরাল, ভাদাম ও মুদাফা এলাকার বিভিন্নস্থানে ইভটিজিং, মাদক কারবার, পেশিশক্তি ব্যবহার করে জমি দখল, ছিনতাই ও চুরিসহ নানা অপরাধে জড়িত রয়েছে বলে এলাকাবাসীর দাবি।
৫৩নং ওয়ার্ডে গ্যাং কালচারে জড়িত রয়েছে হাসিব, আজাদ, তামিম, আব্দুল্লাহ, রমজান, মাহিম ওরফে ডন, সালিম, দীন ইসলাম ওরফে দিনু। এরা হাজীবাড়ি মাইনুদ্দিন মার্কেট, হযরত শাহজালাল রোড, ফকির মার্কেট, কাঁঠালদিয়া, পরানমন্ডলের টেক, মিত্তিবাড়ি ও সিংবাড়ি রোডসহ আশপাশের এলাকায় মহড়া দিয়ে আধিপত্য জাহির করছে। এদের নেতৃত্বে রয়েছে দেওড়া হাজীবাড়ি হযরত শাহজালাল রোডের হায়দার আলীর ছেলে হাসিব। গ্যাংয়ের সদস্যরা ওই রোডের ‘প্রফেসর বাড়ি’ নামে একটি বাড়িতে নিয়মিত আড্ডা জমিয়ে গাঁজা-ইয়াবাসহ নানা ধরণের মাদক সেবন করে থাকে। গত ২২ জুলাই সন্ধ্যায় হেলাল মিয়া নামে এক গাড়ি চালককে মারধর ও ছুরিকাঘাত করে তার কাছে থাকা ১৯ হাজার ৫শ’ টাকা নিয়ে যায়। এ সময় তার স্ত্রী শরীফা বেগম এগিয়ে এলে তার গলায় থাকা আটআনা ওজনের স্বর্ণের চেন জোরপূর্বক নিয়ে যায়। এ ঘটনায় হাসিবকে প্রধান আসামি করে পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করা হলে সে পলাতক রয়েছে। তবে তার অবর্তমানে দলের অন্য সদস্যরা এলাকায় উৎপাত অব্যাহত রেখেছে বলে এলাকাবাসীরা অভিযোগ করেন।
৫৪নং ওয়ার্ডের উত্তর আউচপাড়া খাঁ-পাড়া, পাঞ্জুখান রোড, মরা পুকুরপাড়, সামসুর পোশাক কারখানা এলাকা, ছয়তলা, আবু হানিফা (র.) মসজিদ রোড, সাঈদ খাঁর বাজারসহ আশপাশের এলাকায় গ্যাং কালচার পরিচালনা করছে জনৈক রাজার ভাতিজা নামে পরিচিত তানভীর আহমেদ। এগ্রুপে মুন্নাসহ ১৫-২০ জনের একটি দল এলাকায় মাদক ব্যবসা, মারামারি, ইভটিজিংসহ নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে থাকে। তাদের ভয়ে এলাকার কেউ কথা বলতে সাহস পায় না। এছাড়াও মোল্লাবাড়ি রোড, মোক্তারবাড়ি রোড, সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি রোড, কলেজ রোড, সুলতানা রাজিয়া রোড, সুরতরঙ্গ রোড, চেরাগআলী এলাকায় কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা ভিন্নভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গ্যাং কালচার চালিয়ে আসছে।
৫৫নং ওয়ার্ডের কো-অপারেটিভ মার্কেট এলাকায় হোটেল মুখলেছের ছেলে রাজন, নামাবাজার এলাকায় রনি, জুয়েল, রিপন, সুমন, মালেক, ফাহিম ও দেলোয়ারের নেতৃত্বে কিশোর গ্যাংয়ের একটি দল পুরো মিলগেট, টঙ্গী-কামারপাড়া রোড, অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলস, মুন্নু টেক্সটাইল মিলস, কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস, লাল মসজিদ বস্তি, নামাবাজার বস্তি, বর্জিত তুলার গুদাম এলাকায়, কলাবাগান বস্তি, জিন্নাত বস্তি, নিশাতবস্তিসহ পুরো ওয়ার্ডে উৎপাত করে চলেছে। তাদেরকে ৫৫নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহীম সানি শেল্টার দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এব্যাপারে জানতে চাইলে ইব্রাহীম সানি বলেন, তাদেরকে আমি চিনি কিন্তু গ্যাং কালচারের সাথে জড়িত ও এলাকায় উৎপাত করে বলে আমার জানা নেই। যদি তারা গ্যাং কালচারের সাথে জড়িত থাকে তাহলে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে।
টঙ্গী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, পাইলট স্কুল এ- গালর্স কলেজ, সফিউদ্দিন সরকার একাডেমি এ- কলেজ, সাতাইশ হাইস্কুল এ- কলেজ, কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিলস উচ্চবিদ্যালয়, নিশাত জুট মিলস আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়সহ এলাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা উদ্বেগের সাথে বলেন, উঠতি বয়সি কিশোররা গ্যাং কালচারের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও ছেলে-মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, উচ্চশব্দে বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল মহড়ায় আমাদের সবসময় তটস্থ থাকতে হয়। এগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিবৃত করা না গেলে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে টঙ্গী পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শাহ আলম বলেন, পশ্চিম থানা এলাকায় কোনো প্রকার গ্যাং কালচার ও মাদক ব্যবসা বরদাশত করা হবে না। ইতোমধ্যে আমরা কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে বিট ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করেছি। কিশোর গ্যাং সদস্যদের উৎপাত দেখা দিলে সাথে সাথেই তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।