বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়ের ৭ম বর্ষপূর্তি ও ৮ম বর্ষে পদার্পন অনুষ্ঠান আজ ৩১ জুলাই মধ্য রাতে নানা উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করলো বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী।।
২০১৫ সালের ৩১ জুলাই এই দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কুটনৈতিক প্রচেষ্টায় ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতি জ¦ালিয়ে দু’দেশের অভ্যন্তরে থাকা ১৬২ টি ছিটমহল বিনিময় করা হয়।
সেই থেকে এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে দেশের সর্ববৃহৎ বিলুপ্ত ছিটমহল কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়া বাসীসহ বাংলাদেশ অভ্যন্তরের ১১১টি বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষরা নানা আয়োজনে ছিটমহল বিনিময় বর্ষপূর্তী পালন করছে।
রোববার দিবাগত মধ্যরাতে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ¦লন করে ছিটমহল বিনিময়ের ৭ম বর্ষপূর্তি ও ৮ম বর্ষে পর্দাপন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠানিক ভাবে পালন করবে দাসিয়ারছড়াবাসীসহ বাংলাদেশ অভ্যন্তরের ১১১টি বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ।
এরমধ্যে সর্ববৃহৎ বিলুপ্ত ছিটমহল কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়ার কামালপুরবাসী। রাত ১২ টা ১ মিনিটে কামালপুরের শাপলা চত্ত্বরে ৬৮ মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ও কেককাটার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়ের ৭ম বর্ষপূর্তি ও ৮ম বর্ষে পদার্পন অনুষ্ঠান পালন করেছে।
এর সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতা জুলহাস মন্ডল। এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কানু মন্ডল, ফজলুল হক, মনছুর আলী, আনোয়ার হোসেন, আমিনুল ইসলাম, শরিফ উদ্দিন প্রমূখ।
এছাড়াও দাসিয়ারছড়ার কালিহাটে, টনকার মোড়ে দাসিয়ারছড়াবাসী ছিটমহল বিনিময়ের ৭ম বর্ষপূর্তি ও ৮ম বর্ষে পদার্পন অনুষ্ঠান করেছে। কালিরহাটের কর্মসূচীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাফর আলী।
এতে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী, গন্যমান্য ব্যক্তিরা ও গণমাধ্যম কর্মীরা।
সমন্বয় কমিটির নেতা জুলহাস মন্ডল বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী ছিটমহল বিনিময় চুক্তি করে। এই চুক্তি বাস্তবায়নে আমরা ভারতের এমএলএ দীপক সেনের উদ্যোগে ও পরে তার ছেলে দীপ্তিমান সেনের নেতৃত্বে ২০০৬ সাল থেকে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করেছি।
পরবর্তীতে আমাদের আন্দোলন সমর্থন করে পিতার চুক্তি থেকেই ছিটমহল বিনিময় করে আমাদের মুক্তি দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। আমরা আজ আনন্দিত উল্লাসিত। আজ ছিটমহল বিনিময়ের ৭ম বর্ষপূর্তি ও ৮ম বর্ষে পদার্পন অনুষ্ঠান পালন করছি। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার কন্যা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
স্থানীয় কামালপুর মইনুল হক উচ্চবিদ্যালয়ের অফিস সহকারী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা ছিটমহল বিনিময়ের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান প্রতিবছরেই কামালপুরে পাালন করে আসছি। ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতি জ¦ালিয়ে আমরা ছিটহল থেকে স্বাধীন হওয়ার অনুষ্ঠান পালন করছি। এটা আমাদের স্বাধীনতা দিবসের মতো।
উল্লেখ্য, ৬৮ বছর ধরে বন্দিত্ব জীবন যাপন করে বাংলাদেশ-ভারতের ১৬২ ছিটমহলের বাসিন্দারা। তারা বাংলাদেশ-ভারতের ছিটমহল নামের একটি ভূ-খন্ডে বসবাস করলেও কোন দেশেরেই সুবিধা পাননি। ছিটমহল নামের কারাগার থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করেন এসব মানুষ।
১৯৭৪ ইং সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের ছিটমহলগুলো বিনিময় করার বথা থাকলেও পরবর্তীতে ওই চুক্তি বাস্তবায়ন বন্ধ হয়। ফলে ১৯৯৪ ইং সাল থেকে বাংলাদেশ-ভারতের ১৬২ ছিটমহলের বাসিন্দারা বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির ব্যানারে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির বাস্তবায়নের দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু করেন।
ছিটমহলের বাসিন্দাদের আন্দোলন ও তাদের দুঃখ-দূর্দশার তথ্যবহুল সংবাদ গণমাধ্যম কর্মীরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ শুরু করলে সারাবিশে^ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বত্রে ছিটমহল বিনিময়ের যৌতিক দাবি ছড়িয়ে পড়ে। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির বাস্তবায়ন অলোর মুখ দেখতে শুরু করে।
পরে ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নে মানবিক দৃঢ়তা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা ও মোদি সরকার। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বিনিময় হয় ভারত-বাংলাদেশের ১৬২ ছিটমহল।
এতে করে ৬৮ বছরের বন্দী জীবনের অবসান ঘটে ছিটমহলবাসীর।
নাগরিকত্ব মেলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের প্রায় ৩৭ হাজার মানুষের। আর ভারতের নাগরিকত্ব পায় ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ১৪ হাজার মানুষ।
ছিটমহল বিনিময়ের পর থেকে ১৮১ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের মাধ্যমে ১১১টি ছিটমহলে উন্নয়ন কাজ শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। এর মধ্যে শুধু কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়ার উন্নয়নে ব্যয় করা হয় ৮১ কোটি টাকা। পাশাপাশি াবলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের এগিয়ে নিতে কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা।
এরই মধ্যে দেশের সর্ববৃহত ছিটমহল কুড়িগ্রামের দাসিয়ারছড়ায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ৩টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়। এ বছর নতুন করে ১টি দাখিল মাদ্রাসা, ৩ টি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে এমপিওভুক্ত করা হয়।
এছাড়াও চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ২২ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ব্রীজ-কালভার্ট, মসজিদ-মন্দির, নিশ্চিত করা হয়েছে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য সেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নিমার্ণ করা হয়েছে।
বিলুপ্ত ছিটমহর দাসিয়ারছড়ার মানুষেরা এখন ভিজিডি, ভিজিএফসহ সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে।