রিকশাভ্যানচালক আলম ইসলামের ভাঙাচোরা বাঁশের বেড়া আর জরাজীর্ণ ঢেউটিনের ঝুপড়িঘর। এই ভাঙাচোরা বাঁশের বেড়া আর জরাজীর্ণ ঢেউটিনের ঝুপড়িঘরেই কেটেছে আলমের মেয়ে আঁখি আক্তারের কৈশোর। আঁখির বর্তমান বয়স অন্তত ২২ বছর। দীর্ঘ ১৫ বছর পর মুক্ত বাতাস পেয়ে আবেগাপ্লুত আঁখি। হতদরিদ্র্য রিকশাভ্যানচালক আলম ইসলামের বাড়ি দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার আঙ্গারপাড়া ইউনিয়নের জমির চেয়ারম্যানপাড়ায়।
পরিবার ও এলাকাবাসী জানায়, সমাজের অন্যান্য শিশুর মতোই দুরন্তপনায় মেতে ছিল আঁখি। শিশু আঁখির মাত্র ৯ বছর বয়সে তৃতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় স্বাভাবিক চলাফেরায় দেখা দেয় সমস্যা। হতদরিদ্র্য রিকশাভ্যানচালক আলম ইসলামের অভাবের সংসার। রিকশাভ্যান চালিয়ে কোনরকমে জীবিকা নির্বাহ করতো। আয়-রোজগার না হলে ঠিকমতো তিনবেলা খাবারও জুটে না তাদের। অর্থাভাবে তাদের ঘরের অবস্থাও জরাজীর্ণ। এই প্রতিবন্ধী মেয়েকে চিকিৎসা করানোর সাধ থাকলেও সাধ্য নেই ভ্যানচালক পিতার।
আরও জানা গেছে, ৭ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে আঁখি সৎমায়ের সংসারে শৈশব শুরু করে। বাড়ির পাশে একটি ব্র্যাক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইটের টুকরায় পা লেগে পিছলে পরে যায় আঁখি। সেই থেকেই তার পায়ে ব্যথা শুরু হয়। আস্তে আস্তে পচন শুরু হলে দিনাজপুর ও রংপুরে চিকিৎসকের পরামর্শনুযায়ী চিকিৎসা করা হয় আঁখির। এতেও সে সুস্থ না হলে রিকশাভ্যানচালক পিতা আলম ইসলামের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অভাবের সংসারে আর তাঁর উন্নত চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় দু'পায়েই আঁখির পচন শুরু হয়। এতে তার বন্ধ হয়ে যায় চলাফেরা। প্যারালাইজড অবস্থায় ঘরবন্দি হয়ে পড়েন আঁখি। এতে তার ১৫টি বছর কাটে আবদ্ধ ঘরেই। তার বিছানাতেই খাওয়া-দাওয়া, প্রেসাব-পায়খানা, গোসল ও প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন চলে। এভাবেই মানবেতর জীবনযাপন করছে আঁখি। রিকশাভ্যানচালক পিতা আলম ইসলাম ও সৎমা কহিনুর বেগম সাংসারিক কাজের পাশাপাশি তাঁর সেবা শুশ্রুষা করে দিন পার করছেন।
আলম ইসলাম বলেন, আমার মেয়ে বাইরে বের হতে পারবে এই আশা প্রায়ই ছেড়ে দিয়েছিলাম। অভাবের সংসারে রিকশাভ্যান চালিয়ে ৬ সদস্যের পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হত। তাই আর আঁখির চিকিৎসা করাতে পারিনি। গত ১৩/১৪ বছর থেকে মেয়েটা ঘর থেকে বাইরে বের হতে পারেনি। এ বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হওয়ার পরই খানসামা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সফিউল আযম চৌধুরী লায়নের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি তাদের বাড়িতে এসে আঁখিকে দেখে ঔষধের জন্য কিছু টাকা দিয়ে যান। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান সফিউল আযম চৌধুরী লায়ন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাশিদা আক্তার তাঁর খোঁজ নিতে ছুটে যান। এ সময় তাঁরা ওই তরুণীকে আর্থিক সহায়তা ও চলাচলের জন্য হুইলচেয়ার প্রদান করেন। তার চিকিৎসার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও তাকে যাতে আর ঝুপড়ি ঘরে থাকতে না হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাকা বাড়ির ব্যবস্থা করা হবে।
হুইল চেয়ারে করে ঘরের বাইরে আসায় মুক্ত বাতাসে বের হওয়ার সময় আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই তরুণী। আঁখি যেন তার আগের সেই উন্মুক্ত জীবন ফিরে পেল। সে ১৫ বছর পর দিনের আলো ও প্রতিবেশীদেরকে দেখতে পেয়ে আবেগপ্লুত হয়ে পড়ে।
আঁখির পিতা আলম জানান, এই দুঃসময়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর এই সহায়তা তাঁর পরিবারের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তাঁদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
এ সময় উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস্ চেয়ারম্যান আফরোজা পারভীন, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ মমেন শাহসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।