চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আন্তজার্তিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ধাক্কা লেগেছে দেশের তথা কালীগঞ্জে সারের বাজারে।এই উপজেলার প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমির আমন ধানের আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভাজ পড়েছে কৃষকের কপালে। ইউরিয়া সারের দাম ডিলার পর্যায়ে ৬ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে এই সারের ডিলার মূল্য ২০ টাকা, কৃষক পর্যায়ে করা হয়েছে ২২ টাকা। ১ আগস্ট থেকে সারের এ দাম কার্যকর করা হলেও তা মানছেন না কালীগঞ্জের বিসিআইসি অনুমোদিত সারের ডিলার এবং সাব ডিলাররা। হঠাৎ করে সারের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা হওয়ায় ডিলারদের গুদামে রয়ে যাওযা ইউরিয়া সার গুলো নতুন দামে বিক্রির অভিযোগ করছেন খোদ কৃষকরাই। অবশ্য ঝিনাইদহ জেলার অন্যান্য উপজেলায় পূর্বের মূল্যে ডিলারদের কেনা ইউরিয়া সার মাইকিং করে খোলা বাজারে বিক্রি করলেও কালীগঞ্জ কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সেরকম কোনো উদ্যোগ গ্রহন করতে দেখা যায়নি। ফলে কালীগঞ্জ উপজেলার অনুমোদিত ১৪ জন বিসিআইসি ডিলারের মধ্যে অনেকে এবং তাদের অধীনে সাব ডিলাররা নিজেদের ইচ্ছামত বাড়তি দামে সার বিক্রি করছেন।এতে করে কৃষক প্রতি কেজি ইউরিয়া সার কিনছেন ২৬ থেকে ২৮ টাকায়। ফলে কৃষককে এক দিকে বাড়তি দামে সার কিনতে হচ্ছে অন্যদিকে আবার চাহিদা মাফিক সারও তারা পাচ্ছেন না। ইউরিয়া সারের পাশাপাশি পটাশ সারেরও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। ৫০ কেজির পটাশ সারের ১ বস্তায় ডিলার মূল্য হলো ৭৩০ টাকা। অথচ ৭৩০ টাকার ১ বস্তা পটাশ সার কৃষক কিনছেন ১৪৫০/১৫৫০ টাকায়। বিসিআইসি সার ডিলারদের ১১ টি ইউনিয়নে গুদামসহ সারের দোকান থাকার কথা থাকলেও সব ইউনিয়নে তা নেয়। অধিকাংশ ডিলাররা কালীগঞ্জ শহর থেকে ব্যাবসা পরিচালনা করেন। ফলে খুচরা সার বিক্রির ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় ইউনিয়ন ভিত্তিক নির্ধারিত ডিলারের কাছ থেকে সার না কিনে পচ্ছন্দমত ডিলার বা সাব ডিলার দের নিকট থেকে সার কিনছেন কৃষকরা। আবার ইউনিয়ন বা গ্রাম থেকে একজন কৃষক শহরে সার কিনতে আসলে তার খরচ আরো বেড়ে যায়। অনেক সময় সার না পাওয়ায় হয়রানির শিকারও হন তারা। কৃষি অফিস কৃষকের এই ব্যাপার গুলো কখনোই আমলে নেন না বলে অভিযোগ করেন অনেক কৃষক। কালীগঞ্জ কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুজিত কুমার বিশ্বাস ও আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, সারের কৃত্রিম সংকট ও বাড়তি দামে কৃষকের সার কেনার ব্যাপারে তারা কিছু জানেন না। তাদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে যায়, কৃষকের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তারা কতটুকু গুরুত্বের সাথে নেন।
কালীগঞ্জ বাজারের থানা রোডে অবস্থিত বিসিআইসি ডিলার মেসার্স গুডলাক ট্রেডার্সে শনিবার বিকালে ১ বস্তা ইউরিয়া ও ১ বস্তা ড্যাপ সার কিনতে আসেন নিয়ামতপুর ইউনিয়নের ফারাশপুর গ্রামের কৃষক মহিউদ্দিন বিশ্বাস। এই সারের ডিলার বিকাশ চন্দ্র দাস তাকে জানান,সার নেই। সার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, "সার নেই তাই না? গোডাউনে গেলে ঠিকই সার পাওয়া যাবে। কেন নেই বলছে তাও আমরা জানি।" কিছুই বলার নেই, সার নিয়ে কারসাজি নতুন কিছু নয়। মাঝখান থেকে যত ঝামেলা কৃষকদেরই পোহাতে হয়। শিমলা গ্রামের কৃষক আবদুল কুদ্দুস জানান, আমি কালীগঞ্জ থেকে ১৩৩০ টাকায় এক বস্তা ইউরিয়া কিনে আনলাম। সারের এত দাম তারপর আবার কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে কৃষক বাচবে কিভাবে।
কালীগঞ্জ বাফার সার গোডাউনের রসায়নবিদ ও ইনচার্জ মোঃ মুকুল উদ্দিন বলেন,আমন মৌসুমের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ইউরিয়া সার গুদামে রয়েছে। জুলাই মাসে ৮০৫ টন ইউরিয়া সার অনুমোদিত ডিলারদেরকে দেওয়া হয়। ইউরিয়ার মূল্যবৃদ্ধির পূর্ব পর্যন্ত ডিলারদের নিকট কি পরিমাণ সার মজুদ রয়েছে তার হিসাব কৃষি অফিসে রয়েছে। বর্তমানে আগস্ট মাসের জন্য বরাদ্দকৃত ইউরিয়া সারের পরিমাণ হলো ১৪৫৭ টন। কৃষক ন্যায্য মূল্যে সার পাচ্ছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়, এটা উপজেলা কৃষি অফিসের।
নিয়ামতপুর ইউনিয়নের বিসিআইসি ডিলার আনোয়ারুল ইসলাম জানান,আমি সার গুদাম থেকে চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছি না। বিএডিসি থেকে ১ বস্তা পটাশ ও শুধু আমি কেনো কোনো ডিলারই পায়নি। নিয়মিত সার না পাওয়ার কারণেই মূলত সারের সংকট তৈরি হচ্ছে।
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের সাব ডিলার মাহিন হোসেন বলেন,আমাদের চাহিদার বিপরীতে ডিলাররা সার দেন খুব কম। আবার যখন বেশি টাকা দেবো তখন চাহিদার থেকেও বেশি সার মেলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরো একজন সাব ডিলার জানান,সারের কোনো সংকট নেই। ডিলাররাই সার সংকট তৈরি করে রেখেছে অধিক দামে বিক্রির জন্য। আর এটা নতুন কিছু নয়। ইউরিয়ার দাম বৃদ্ধির আগে তাদের গুদামজাত করা হাজার হাজার বস্তা ইউরিয়া সার নতুন দামে বিক্রি করেছে। মরলে কৃষক মরুক। ডিলাররা টাকা কামাতে পারলেই হলো।কৃষি কর্মকর্তা যদি ঠিকঠাক মত বাজার মনিটরিং করতেন তাহলে হয়তো অসাধু ব্যবসায়িরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারতেন না। উল্লেখ্য, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। আমন মৌসুমে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে ইউরিয়া সারের চাহিদা ৬ লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন, বিপরীতে বর্তমানে মজুত রয়েছে ৭ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন, যা প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় ১ লাখ টন বেশি। অন্যান্য সার যেমন টিএসপির আমন মৌসুমে চাহিদা ১ লাখ ১৯ হাজার টন, বিপরীতে মজুত ৩ লাখ ৯ হাজার টন, ডিএপির চাহিদা ২ লাখ ২৫ হাজার টন, বিপরীতে মজুত ৬ লাখ ৩৪ হাজার টন এবং এমওপির চাহিদা ১ লাখ ৩৭ হাজার টন, বিপরীতে মজুত রয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টন।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মোহাইমেন আক্তার বলেন, সারের দাম বৃদ্ধির পূর্বে ডিলারদের নিকট যে পরিমান সার ছিল সে গুলো অবশ্যই আগের দামে বিক্রি হবে, সেটাই নিয়ম। কালীগঞ্জে প্রচার প্রচারনা করে খোলাবাজারে মূল্য বৃদ্ধির পূর্বের ইউরিয়া সার বিক্রি করা হয়নি। কৃষকরা সার পাচ্ছে না এ কথা ঠিক না।আমন সিজন বড় হওয়ায় কৃষক একবারে সব সার নিতে চাই, একারণেই সমস্যাটা হয়।তবে বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ পেলে সেই ডিলার বা সাব ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পর্যাপ্ত পরিমাণ সার থাকার পরেও ন্যায্যমূল্যে কৃষকের হাতে সার না পৌঁছানোর প্রধানতম কারণ হলো এর সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসের নীরবতা। নিয়মিত ভাবে করা হচ্ছে না সারের বাজার মনিটরিং। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কালীগঞ্জের কৃষক সমাজ। অধিক দামে কিনতে হচ্ছে সার। এ অবস্থার উত্তরণ কি আদৌ হবে? ভাঙবে কি কৃষি অফিসের নিরাবতা ?