বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ১৮ শতাংশ দেয় দেশের এসএমই খাতে। যা পায় মাত্র ৯ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৯১ শতাংশ এসএমই ব্যাংক ঋণের সহায়তা বঞ্চিত। এছাড়াও গত কয়েক বছরে ব্যাংকের মোট ঋণের অনুপাতে এসএমই ঋণের হার কমেছে। যা দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। গত রোববার সকালে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত বঙ্গবন্ধুর এসএমই উন্নয়ন ভাবনা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট শীর্ষক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে এসব কথা বলেন এফবিসিসিআইর প্যানেল উপদেষ্টা ও সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি জানান, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে এসএমইর উন্নয়ন করে বৈষম্য কমিয়ে আনতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের বর্তমান ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের পেছনে এসএমই খাতের বিকাশ না হওয়াকে দায়ী করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি জানান, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে দেশের এসএমই ঋণের সম্ভাব্য বাজার ২৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ কাঠামোতে এসএমই খাত অবহেলিত। তাই এই বিশাল লাভজনক খাতে ব্যাংকগুলো নজর দিচ্ছে না। সেমিনারের প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এমপি ব্যাংকগুলোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শুধু ডলার বিক্রি করে লাভ করার জন্য এতগুলো ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এটা নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। শুধু মুনাফা করাই ব্যাংকের কাজ নয়। তাদেরকে অবশ্যই জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেজন্যই তাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। নগরাঞ্চলে বড় গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে শহর-গ্রামের মধ্যে বৈষম্য বাড়ানো ব্যাংকের কাজ নয়। বরং উন্নয়ন সুষম করার দায়িত্ব। মন্ত্রী বলেন, এসএমই নিয়ে সবাই কথা বলে, কিন্তু কোনো কাজ করে না। সরকারি পর্যায়ের সীমাবদ্ধতাগুলো দ্রুত কাটিয়ে ওঠার আশ্বাস দিয়ে মন্ত্রী বলেন এসএমই ফাউন্ডেশনকে আর্থিকভাবে সক্ষম করতে হবে। এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এসএমই অর্থনীতির মেরুদ-। কিন্তু এই খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দিতে অনীহা রয়েছে। তারা বড় গ্রাহকদের ঋণ দিতে পছন্দ করে। কেননা এতে ব্যাংকারদের কষ্ট কম হয়। এসএমই খাতের মূল সমস্যা অর্থায়ন উল্লেখ করে সভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী এসএমই খাতে ২২ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। বৃহৎ খাতের ঋণ তিন মাসের মধ্যে বিতরণ হলেও, এসএমই খাতের ঋণ দুই বছরেও বিতরণ হয়নি। কেননা ব্যাংকগুলো এসএমইদের টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে প্রতি বছরে ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। এজন্য প্রধান ভূমিকা পালন করবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত। তাই তাদের পাশে ব্যাংকগুলোকে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান সভাপতি। প্রয়োজনে খাতভিত্তিক সমিতি ও জেলা চেম্বারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে আহ্বান জানান তিনি। এ সময় ব্যাংকগুলোর ডলার নিয়ে ব্যবসা করার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সভাপতি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার বিক্রিতে মুনাফার হার নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। কোন কোন ব্যাংক ডলার বিক্রিতে ৪২৫ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে। এমন চললে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু এসএমই খাতের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে উপজেলা পর্যায়ে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপন ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে এসএমইর জন্য প্লট বরাদ্দের আহ্বান জানান। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. মো. মাসুদুর রহমান অভিযোগ করেন, বড়শিল্প যেভাবে সরকারি নীতি সহায়তা পায়, ছোট উদ্যোক্তারা সেভাবে পান না। কর ও শুল্ক কাঠামোর কারণে স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য না কিনে বিদেশ থেকে আমদানি উৎসাহীত হচ্ছে। এ সময় তিনি সরকারি প্রকল্পের জন্য স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয়ের বাধ্যবাধকতা আরোপের আহ্বান জানান। একই অভিযোগ করে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান বলেন, এসএমই বিকাশে সরকারের আর্থিক আনুকূল্য ও প্রকল্প আনুকূল্য পাওয়া যায় না। ২০১৯ সালের এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য ২ হাজার ১৪১ কোটি টাকার বাজেট হলেও তার বিপরীতে কোনো অর্থ পাওয়া যায়নি বলে জানান এসএমই ফাউন্ডেশনের এমডি। সেমিনারে আরো উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী, মো. হাবীব উল্ল্যাহ ডনসহ পরিচালকরা। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআইর মহাসচিব মোহাম্মদ মাহফুজুল হক।