রাজধানীর উত্তরায় নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে একটি প্রাইভেটকারের পাঁচ আরোহী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আরও দুই যাত্রীকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। সোমবার বিকেলে জসীম উদ্দীন মোড়ে আড়ংয়ের সামনের সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। জানা যায়, ক্রেন দিয়ে গার্ডার উঠানোর কাজ চলছিল। এ সময় প্রাইভেটকার নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন ক্রেনটির এক পাশ উল্টে গার্ডারটি ছিটকে গাড়ির ওপরে পড়ে। দুর্ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার ভেঙে পড়েছে খয়েরি রঙের একটি প্রাইভেটকারের ওপর। ভারী গার্ডার মাঝ বরাবর পড়ায়, প্রাইভেটকারটি একদম চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। রাস্তায় জমাট রক্ত দেখতে পাওয়া যায়। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়িটি উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও চেষ্টা করতে দেখা যায়। এর আগে গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে একই প্রকল্পের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। ওই দুর্ঘটনায় এক শ্রমিক ও একজন পথচারী আহত হন। মূলত, অতীতের ঘটনায় দায়ীদের চিহ্নিত না করা এবং বিচার না হওয়ায় উত্তরার মতো এমন দুর্ঘটনা বারবার ঘটেছে বলে আমরা মনে করি। এর আগে ২০১২ সালে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়ে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। পরে মগবাজার ফ্লাইওভার নির্মাণের সময়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটুকু উন্নত সেটি নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে।
জানা যায়, ২০১২ সালে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ওই সময় মোট ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকার এ প্রকল্পটি শেষের মেয়াদ বলা হয়েছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে উন্নীত করা হয় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকায়। কিন্তু এ নির্ধারিত সময়েও বিআরটির কাজ শেষ করা যায়নি। কারণ ঠিকাদারদের গ্রহণযোগ্য কর্মপরিকল্পনা তৈরির মতো দক্ষ জনবল, সরঞ্জাম, অর্থ, প্রয়োজনীয় উপকরণ কিছুই নেই। এ কারণে মিল ছিল না তাদের কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবেরও। সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৯১৭ দিনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কর্মপরিকল্পনা বদল করেছে ছয়বার। তাদের সপ্তম সংশোধিত পরিকল্পনায় ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট কাজ শেষ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে অতিরিক্ত ৭৭৩ দিন ধরা হয়েছে। এভাবে বারবার একটি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রকল্পটি নিয়ে গড়িমাসিরই প্রমাণ।
বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার পড়ে পাঁচজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি চরম অবহেলা। নির্মাণ কাজের যে ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল, তা নেওয়া হয়নি। নির্মাণাধীন এলাকায় যান চলাচলের যে বিধান রয়েছে তাও অনুসরণ করেননি প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। নির্মাণ কাজ করতে হলে অবশ্যই নিরপত্তা বেষ্টনী তৈরি করতে হয়। বেষ্টনী তৈরির পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকবল থাকে দুইপাশে। তারা সেখানে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন; যেন কোনো কারণে যানবাহন বা মানুষ নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ঢুকে না পড়ে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এরকম কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। এই ঘটনাটিকে আমরা দুর্ঘটনাই বলব। তবে অবহেলার জন্য দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এখানে সেফটি রুলস মানা হয়নি। আমরা আশা করি এ ঘটনায় কারও দায় থাকলেও তা বেরিয়ে আসবে এবং ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়ে প্রতিটি প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে।