মাতৃগর্ভে ভ্রƒণের বৃদ্ধিতে মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই গর্ভধারণের পর থেকেই গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক বিশেষ যতেœর প্রয়োজন। জানাচ্ছেন ডা. সুমাইয়া আক্তারমায়ের দেহ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করেই ভ্রƒণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি লাভ করে এবং মানবশিশুতে পরিণত হয়। মাতৃগর্ভে ভ্রƒণের বৃদ্ধিতে মায়ের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সব অবস্থাই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই গর্ভধারণের পর থেকেই গর্ভবতী মায়ের শারীরিক ও মানসিক বিশেষ যতেœর প্রয়োজন।
যে বিষয়গুলো জানতে হবেÑ
-সম্ভাব্য সন্তান প্রসবের তারিখগণনা।
-মায়ের খাদ্যতালিকা।
-অন্যান্য বিষয়ের উপদেশসমূহ।
-টিকা গ্রহণ।
-নিয়মিত চেকআপ।
-জটিলতার চিহ্নসমূহ।
সম্ভাব্য ডেলিভারির তারিখ গণনা
এই বিষয়টি সম্পর্কে চিকিৎসক আপনাকে ধারণা দেবেন। তার পরও আপনি স্বাভাবিকভাবে যে বিষয়টি মনে রাখতে পারেন সেটি হচ্ছে, শেষ মাসিকের তারিখ থেকে ৯ মাস সাত দিন পরে সাধারণত সম্ভাব্য ডেলিভারির তারিখ গণনা করা হয়। এ হিসাবে গর্ভকাল মোটামুটি ২৮০ দিন।
গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি ও খাদ্যতালিকা
গর্ভবতী মায়ের খাদ্য সুষম হতে হবে। অর্থাৎ সব কটি খাদ্য উপাদান সঠিক অনুপাতে পরিবেশন করতে হবে। গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসের পর থেকে মাকে অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
সাপ্লিমেন্ট খাবার ও মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস
প্রথম তিন মাস গর্ভের বাচ্চার নিউরাল টিউব ডেভেলপমেন্টের জন্য ফলিক অ্যাসিড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার চিকিৎসক স্বাভাবিকভাবেই এগুলো আপনাকে দিয়ে থাকেন। তাই গর্ভকালীনের শুরুতেই একজন চিকিৎসকের পরামর্শে এ ধরনের মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টসের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার জন্য নির্দেশিত ওষুধ খেতে হবে। পরবর্তী ছয় মাস আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স নিয়মিতভাবে প্রয়োজন।
সচেতন থাকুন এসব বিষয়েও
পোশাক : সুতির ঢিলেঢালা পোশাক। হিল জুতা পরিহার করতে হবে। পেটিকোট টাইট করে না পরাই ভালো।
ভ্রমণ : গর্ভধারণের প্রথম ও শেষ দিকে ভ্রমণ নিয়ে সচেতন হতে হবে। প্রথম তিন মাস এবং শেষ তিন মাস ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
গোসল : প্রতিদিন গোসল করা আবশ্যক।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা : দাঁত ব্রাশ করা, চুল, নখ, পোশাক পরিষ্কার রাখতে হবে।
ব্যায়াম ও বিশ্রাম : প্রতিদিনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ও সকাল-সন্ধ্যা ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে। দিনে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম এবং রাতে আট ঘণ্টা ঘুম গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভবতী মায়ের টিকা বা ভ্যাকসিন
গর্ভাবস্থার আগে যদি পাঁচবার টিটেনাস টিকা নিয়ে থাকেন, তাহলে আর কোনো টিকার প্রয়োজন নেই। যদি এ রকম না হয়, তাহলে পাঁচ থেকে ছয় মাসে টিটেনাস টিকার প্রথম ডোজ নিতে হবে। এর এক মাস পর আরো একটি টিটেনাস টিকা নিতে হবে। পরবর্তী গর্ভধারণ পাঁচ বছরের মধ্যে হলে শুধু পঞ্চম মাসে একটি টিটেনাস টিকা দিলেই হবে। তবে দ্বিতীয় গর্ভধারণের বিরতি পাঁচ বছরের বেশি হলে পরবর্তী গর্ভধারণেও দুইবার টিকা নিতে হবে।
করোনা বা কভিড-১৯ ভ্যাকসিন : গর্ভধারণের প্রথম তিন মাস ব্যতীত অন্য যেকোনো সময় কভিড-১৯ টিকা দেওয়া যাবে।
নিয়মিত চেকআপ
গর্ভবতী মায়ের জন্য সর্বনিম্ন চেকআপ তিনটি। প্রথমটি তৃতীয় মাসে, দ্বিতীয়টি ষষ্ঠ মাসে এবং সর্বশেষটি নবম মাসে। তবে সম্ভব হলে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র কাছে থাকলে প্রতি মাসে চেকআপ করানো উত্তম।
চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাতের স্বাভাবিক সময়সূচি
- প্রথম পর্যায়ের সাক্ষাৎ : মাসিক বন্ধ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে।
- দ্বিতীয় পর্যায়ের সাক্ষাৎ : প্রতি মাসে একবার করে সপ্তম মাস পর্যন্ত।
- তৃতীয় পর্যায়ের সাক্ষাৎ : প্রতি মাসে দুইবার করে অর্থাৎ প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর সপ্তম থেকে নবম মাস পর্যন্ত।
- চতুর্থ পর্যায়ের সাক্ষাৎ : নবম মাস-পরবর্তী প্রতি সপ্তাহে একবার করে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত।
চেকআপের সময় যেসব বিষয় পরীক্ষা করা হয়
গর্ভবতী মায়ের প্রথম তিন মাসে যে চেকআপ করা হয় তখন গর্ভবতী মায়ের ওজন, রক্তের প্রেসার ও রক্তশূন্যতার জন্য পরীক্ষা (সিবিসি) করা হয়। চতুর্থ মাস থেকে পূর্ববর্তী তিনটি বিষয়ের পরীক্ষাসহ আলট্রাসনোগ্রামের পরীক্ষা করা হয়, যার মাধ্যমে পেটে জরায়ুর উচ্চতা, বাচ্চার নড়াচড়া, বাচ্চার হার্টবিটÑএগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়।
ওজন বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ : প্রথম তিন মাসের পর থেকে স্বাভাবিক ওজনের যেকোনো মায়ের প্রতি মাসে দুই কেজি করে ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তবে প্রথম তিন মাস ওজন বৃদ্ধি না-ও হতে পারে। বরং আধা কেজি ওজন কমতে পারে। শেষ তিন মাসে মায়ের স্বাভাবিক ওজনের থেকে মোট ১১ কেজি ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। যাদের ওজন অনেক বেশি, তাদের ওজন বৃদ্ধি পাঁচ থেকে সাত কেজির চেয়ে বেশি হওয়া উচিত নয়।
গর্ভবতী মায়ের ব্লাড প্রেশার : গর্ভবতী মায়ের রক্তের চাপ ওপরের দিকে ৯০-১২০ এমএম এইচজি এবং নিচের দিকে ৬০-৯০ এমএম এইচজির ভেতরে থাকার কথা।
গর্ভকালীন জটিলতার চিহ্নসমূহ
গর্ভকালীন বেশ কিছু জটিলতা হতে পারে। সেগুলোর জন্য কিছু চিহ্ন বা লক্ষণ রয়েছে, যা পর্যবেক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বা হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি।
প্রথম তিন মাসে জটিলতার লক্ষণসমূহ : অস্বাভাবিক বমি, রক্তক্ষরণ ও প্রচ- পেট ব্যথা।
তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ মাসে জটিলতার লক্ষণসমূহ : রক্তক্ষরণ, পেট ব্যথা ও বাচ্চার নড়াচড়া টের না পাওয়া।
সপ্তম থেকে নবম মাসে জটিলতার লক্ষণসমূহ
- অতিরিক্ত মাথা ব্যথা।
- চোখে ঝাপসা দেখা।
- সারা শরীর ফুলে যাওয়া।
- পানি ভাঙা।
- মাসিকের রাস্তায় রক্তক্ষরণ।
- সম্ভাব্য ডেলিভারির তারিখের অনেক আগেই লেবার পেইন শুরু হওয়া।
প্রসবকালীন স্বাভাবিক কিছু সমস্যা
প্রথম তিন মাসে হালকা বমি বমি ভাব অথবা বমি ও মাথা ঘোরানো থাকতে পারে। গর্ভকালীন কোমরে ব্যথা হতে পারে এবং তা শেষ দিকে বেড়ে যেতে পারে। হাতে-পায়ে ব্যথা ও অন্যান্য অঙ্গে ব্যথা হতে পারে। সপ্তম মাসের পর থেকে সামান্য পা ফোলা হতে পারে। এসব বিষয়ের জন্য মাকে আশ্বস্ত করতে হবে। কারণ এগুলো মায়ের স্বাভাবিক কারণেই হতে পারে। এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
গর্ভবতী মায়ের মানসিক যত্ন
- পরিবারের অন্য সদস্যদের উচিত গর্ভবতী মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রকাশ করা।
- সব সময় আনন্দচিত্ত রাখার চেষ্টা করা।
- ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করা।
- যেকোনো ধরনের নেতিবাচক চিন্তা থেকে দূরে থাকা উচিত।
প্রসব-পূর্ব পরিকল্পনা
- কোথায় প্রসব করাতে চান, বাড়িতে নাকি হাসপাতালেÑএ বিষয়ে মনে মনে একটি পরিকল্পনা রাখা।
- জরুরি অবস্থায় বাহনের ব্যবস্থা, যেমনÑঅ্যাম্বুল্যান্স বা গাড়ি অথবা রিকশা বা ভ্যানচালকের নম্বর রাখা উচিত এবং তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা উচিত, যাতে জরুরি অবস্থায় তিনি সহযোগিতা করতে পারেন।
- প্রসবকালীন শেষ দিকে যেকোনো জরুরি অবস্থার জন্য কিছু খরচ হতে পারে। এজন্য আগে থেকেই কিছু সঞ্চিত অর্থ কাছে রাখা ভালো।
- গর্ভবতী মায়ের জটিলতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রক্তক্ষরণ। এ ধরনের জটিলতা যে কারো হতে পারে। এর পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে একই গ্রুপের এক বা একাধিক রক্তদাতার মোবাইল নম্বর সংগ্রহে থাকা উচিত।
লেখক : প্রসূতি, স্ত্রীরোগ, হরমোনজনিত রোগ ও বন্ধ্যাত্ব রোগ বিশেষজ্ঞ এবং ল্যাপারোসকোপিক সার্জন,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা