ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিতর্ক রয়েছে। ভোটদানের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা না থাকায় ইতোমধ্যে অনেক দেশ ইভিএম পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের মতামত তোয়াক্কা না করে গত ২৩ আগস্ট আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির ভাষ্য, ইভিএমে ভোট কারচুপির কোনো সুযোগ নেই।
বিশেষ করে গত ১৭ বছরে পৃথিবীর যতগুলো দেশ ইভিএম গ্রহণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দেশ ইভিএম বাতিল করেছে। বাতিল করেছে এমন দেশের তালিকায় আছে জার্মানি, স্পেন, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে, ভেনেজুয়েলা, ইউক্রেন, মালয়েশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাজ্য।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে বিগত ২২ বছর ধরে ইভিএম চালু রয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সাল হতে ইভিএমের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে অভিযোগ উঠতে থাকে। ভারতের আদালতে ইভিএমের বিরুদ্ধে একাধিক পিটিশন রয়েছে। ২০১৮ সালে দেশটির সিংহভাগ রাজনৈতিক দল এ পদ্ধতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। কংগ্রেস দলের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভির মতে, শুধু তাদের দলই নয় দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দলই মনে করে যত দ্রুত সম্ভব কাগজের ব্যালট আবার ফিরিয়ে আনা উচিত। এ দাবিতে তাঁরা অনড়। ইভিএমের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস নেই।
২০২০ সালে ভারতে বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। ভারতীয় কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ভরদ্বাজ মনে করেন যে, একটি গোপন কোড জানা থাকলেই ই-ভোটিং মেশিনের গণনাপদ্ধতি সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়া সম্ভব। মেশিনের মাদারবোর্ড তখন সে অনুযায়ীই কাজ করবে। মেশিন আগে হাতে পেলে এ কাজ খুবই সহজ। এমনকি মেশিন আগে হাতে না পেলেও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালীন মাঝপথে মাত্র ৯০ সেকেন্ডে এ কাজ করা যায়।
বর্তমানে পুরোপুুরি ইভিএম চালু আছে শুধুমাত্র ভারত, ব্রাজিল, ফিলিপাইন এবং এস্তোনিয়ায়। তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, ভোটব্যবস্থাপনাকে সহজতর করার লক্ষ্য থেকেই সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইভিএম পদ্ধতি চালু হয়। আবিষ্কারের ছয় দশক অতিক্রান্ত হলেও বিশ্বের কোনো দেশেই পুরোপুরি মানুষের আস্থা অর্জন হয়নি ইভিএম পদ্ধতিতে।
এ পর্যন্ত অন্তত ৩৪টি দেশ ইভিএম ব্যবহার কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এরমধ্যে ১৪টি দেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ইভিএম। ১১টি দেশে আংশিক ব্যবহার হচ্ছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ৫টি দেশে। ২০২০ সালেরও আগে ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদ অনুযায়ী বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র যে ৪টি দেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয়, ওইসব দেশেও আছে ইভিএম নিয়ে তুমুল বিতর্ক।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ইভিএমের গ্রহণযোগ্য ব্যবহার ঘটেনি। শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ইভিএম পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ ইভিএম চালু করেছিল এখন তারাও এটি নিষিদ্ধ করেছে। আয়ারল্যান্ডও ২০০২ থেকে ২০০৪ সালে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিতর্কের মুখে দুটি কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইভিএম যন্ত্র 'বিশ্বাসযোগ্য নয়'। প্রযুক্তিগত রক্ষাকবচ অপ্রতুল। সবদিক বিবেচনায় ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ইভিএম পরিত্যাগ করে।
২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। একই বছর সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
২০০৭ সালে নেদারল্যান্ডস ইভিএম ব্যবস্থা বাতিল করেছে কারচুপির কারণে নয়, বরং এই মেশিন টেম্পারিং করা যাবে নাÑএ ধরনের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না বলে। ড. অ্যালেক্স হালডারমেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছেন, আমেরিকায় ইভিএম টেম্পারপ্রুফ নয়। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকায় ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে ইভিএম-কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও নিষিদ্ধ করার পথে।
বাংলাদেশে ইভিএমের সর্বপ্রথম সূত্রপাত ঘটে এক এগারোর সময়কারের শাসনামলে। তৎকালীন এটিএম শামসুল হুদা কমিশন স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএমের প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সহায়তায় প্রথমে ২০১০ সালে এ প্রযুক্তির ৫৩০টি মেশিন কেনা হয়। ব্যবহার করতে গিয়ে ইভিএমে নানা যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) প্রস্তুত করা ৭০০ ইভিএম কেনা হয়। এগুলোও পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল না। শামসুল হুদা কমিশন ২০১১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ২১ নং ওয়ার্ডে বুয়েটের ইভিএম ব্যবহার করে।
পরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, টাঙ্গাইল পৌরসভা ও নরসিংদী পৌরসভায় এ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় হুদা কমিশনের স্থলে বিধির নিয়মে নতুন কমিশন হিসেবে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদায়ী রকিব উদ্দিন কমিশন দায়িত্ব নেয়। তাদের মেয়াদে রাজশাহী সিটিতে ২০১৩ সালে ইভিএম ব্যবহার করে পুরো বিতর্কের মধ্যে পড়ে যায় ইসি। পরে কমিশনার হিসেবে মেয়াদ পূর্ণের আগে ইভিএম ব্যবহার করেনি। তবে, নতুন ইভিএমের প্রচলন চালু রেখে যায়। আর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেএম নূরুল হুদার কমিশন দায়িত্বে এসে কমিটি করে পুরনো ইভিএমকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। (তথ্যসূত্র : ইত্তেফাক- ২৪.০১.২০২০)
আমাদের দেশে ইভিএম নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ব্যালটের চেয়ে ইভিএমের খরচ একটু বেশি হলেও নির্বাচনি অনিয়ম দূর করা সম্ভব বলে ইসি মনে করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় ইভিএমও অরক্ষিত। বিগত সময়ে ভোটের রাতে কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটলেও এখন দিনে কেন্দ্র দখল করে ইভিএমে জাল ভোট দেওয়া সম্ভব। ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটারের ফিঙ্গার ম্যাচিংয়ের পর ব্যালট ইউনিটে অন্য যে কেউ ভোট দিতে পারেন। দুটি ইউনিটে বিভক্ত ইভিএম, ব্যালট ও কন্ট্রোল ইউনিট। ব্যালট ইউনিটে প্রার্থীদের নাম ও মার্কা সংবলিত ছবি এবং সুইচ থাকবে। কন্ট্রোল ইউনিটে চারটি অংশ থাকতে পারেÑপ্রসেসর, স্মৃতি, ডিসপ্লে ও ব্যাটারি। ফিঙ্গারপ্রিন্টের পর ভোটার তার পছন্দের মার্কাসংশ্লিষ্ট সুইচে চাপ দেবেন এবং কন্ট্রোল ইউনিট প্রার্থী অনুযায়ী ভোট প্রসেস করে ভোটের হিসাব রাখবে। ভোট শেষে প্রার্থীদের এজেন্টদের উপস্থিতিতে কন্ট্রোল ইউনিট থেকে ভোটের ফলাফল জানা যাবে।
ইভিএমের বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, 'উন্নত দেশগুলো কেনো ইভিএম পরিত্যাগ করেছে তা আগে অনুধাবন করতে হবে। ইভিএমে ভোটদানের পর ভোটার কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারেন না।
বিশেষ করে বাংলাদেশের ইভিএম কেনো ঠিক সকাল আটটায় সুইচ অন করে সিংক করা লাগে, আগের সিংক করা ইভিএম কেন কাজ করে না, তার কারিগরি ব্যাখ্যা নেই। ইভিএমে ভিন্ন ভিন্ন অপারেটিং অ্যালগরিদম মুড আছে কি-না, তা অজানা। ঠিক চারটায় মেশিন ভোট নেওয়া বন্ধ করে। মাঝে কারিগরি ত্রুটি কিংবা যন্ত্র হ্যাং করলে কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে কোনো সমস্যা হলে লাইনে অপেক্ষমাণ ভোটার ভোট না দিয়েই কেন ফিরে যাবেনÑএসবের উত্তর নেই।
অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সাইফুর রহমানের মতে, ইভিএমের সঙ্গে সংযোজিত যেকোনো ইনপুট পোর্টের মাধ্যমে যন্ত্রটির ভেতর ম্যালওয়্যার-মলিকুলাস কোড প্রবেশ করিয়ে ভোটের ফলাফল বিকৃতি করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই যন্ত্রটির ভেতরে গোপনে মুঠোফোনের সিম-জাতীয় আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) কিংবা গোপন যন্ত্রাংশ বা ডেটা এন্ট্রি পোর্ট সংযোগ স্থাপন করে দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ডিজিটাল অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা আছে (এতে গোপনীয়তা বিঘিœত হওয়ার ঝুঁকি আছে)। তবে ব্যবস্থাটিও যেহেতু সফটওয়্যার-চালিত, তাই সোর্স কোডসংক্রান্ত সমস্যাটি এখানে থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচনের ঠিক আগে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রতিটি ইভিএম মাদারবোর্ড পরীক্ষা করা, পরীক্ষা শেষে প্রতিটি সফটওয়্যারের ডিজিটাল ছাপ (ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট) সংরক্ষণ করা দুরূহ কাজ। সব কটি যন্ত্রের (প্রায় ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্র এবং লক্ষাধিক ইভিএম) হার্ডওয়্যারের লিস্ট, সার্কিট ডিজাইন, হার্ডডিস্কের ফরেনসিক কপি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রধান প্রধান রাজনৈতিক পক্ষকে দেওয়া হচ্ছে না এবং তাদের সেসব যাচাইয়ের কারিগরি সক্ষমতাও নেই। বুয়েটের ডিজাইন করা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি কিংবা ওয়ালটনের তৈরি করা হার্ডওয়্যার তাঁদের পছন্দ হয়েছে। ড. কায়কোবাদ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘ইভিএম আমরা নিজেরা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখিনি।’ ইভিএমের সফটওয়্যার আর্কিটেকচার, অপারেটিং সিস্টেম ও অ্যালগরিদমই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু ইভিএমে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের ওপরই নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে, তাই এই অংশের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, তার পক্ষে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করা অত্যন্ত সহজ। (তথ্যসূত্র : ডেইলি স্টার-২৮.০৫.২০২২)।
মূলত, ইভিএম নিয়ে বিতর্ক ও নানাবিধ জটিলতার কারণে উন্নত দেশগুলো ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে গেছে। ইভিএম নিয়ে পশ্চিমা দেশের একাধিক পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে, মূলত বলপ্রয়োগে পরিচালিত সরকারগুলোয় ইভিএম চাপিয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে।
বলা বাহুল্য যে, ইসির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের মিত্র জাতীয় পার্টিসহ ১৫টি রাজনৈতিক দল ইভিএম মেশিন ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে। সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ এমন ৯টি দলও ওই মেশিনে ভোটগ্রহণের বিরোধিতা করে আসছে। জামায়াতে ইসলামীও ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করছে। দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করছে। শুধু আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
তবুও আগামী নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। প্রশ্ন হলো সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে কেনো এমন সিদ্ধান্ত ? কার স্বার্থে ইভিএম ? এ প্রশ্ন দেশ তথা বিশ্ব বিবেকের নয় কী?
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহসম্পাদক)