আম্মু-আব্বু আমাকে মাফ করে দিও। আমি অন্যায় করেছি, আমার সাজা হওয়া উচিত। আমি আর কোন কিছু সহ্য করতে পারছি না। খুব অসহায় লাগছে। তুমিই তো বলোÑ আমার মতো মেয়ের দরকার নেই। আমি এভাবে তোমাদের কষ্ট দিতে চাই না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি এ জীবন সহ্য করতে পারছি না। আমি একজনকে ভালবাসি। আমি খারাপ, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। তাই আমি চলে গেলাম। পুলিশ ও নাঈমার বন্ধুরা জানান, তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বাবু নামে এক সহপাঠীর। বিষয়টি নাঈমার মা-বাবা জেনে ক্ষুব্ধ হন তার প্রতি। ঈদের ছুটি কাটিয়ে গত ৮ আগস্ট কেশবপুরের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার আগে নাঈমার মোবাইলফোনটি কেড়ে নেন তারা। অন্যদিকে নাঈমার প্রেমিক বাবু তার সঙ্গে প্রতারণা করে। তারই সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। মানসিক এ চাপ সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় নাঈমা। প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। সারাদেশে যেসব অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তার একটি বড় অংশই আত্মহত্যাজনিত কারণে হয়ে থাকে। জীবনের প্রতি অনীহা থেকে প্রতিদিন কেউ না কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
অপমৃত্যু থেকে দেশের মানুষকে রক্ষার জন্য কোন কার্যকর উদ্যেগ নেই সরকারের। যে কারণে দেখতে হচ্ছে- একের পর এক মৃত্যুর সংবাদ। এমনই এক অপমৃত্যুর ঘটনায় নুসরাত স্তব্ধ। অন্যদিনের মতোই স্কুল থেকে মায়ের সঙ্গে রিকশায় ফিরছিল সে। মা আর ফেরেননি তার সঙ্গে। ফিরেছেন লাশবাহী গাড়িতে। নুসরাতকে স্তব্ধ করেছে এক ভয়াবহ স্মৃতি। রিকশা থেকে বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মা আর সে। মা পড়ে গেলেন বাসের চাকার নিচে। অনেক রক্ত। চিৎকার। ভিড়। তারপর ফুটপাথে শুইয়ে রাখা হলো মাকে। রক্তভেজা। নীরব। ২০১৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কমলাপুরে ঘাতক বাস কেড়ে নিলো নুসরাত সামিয়া নামের শিশুর চোখের সামনে তার মা রোকসানা বেগম লায়লাকে (৩৭)। শুধু লায়লাই নয়, প্রতিদিন এমন অনেক অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ যেন অপমৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল। এক একটি জীবনের সঙ্গে একেকটি স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে। একটি মৃত্যু সব কিছু শেষ করে দেয়। অনেকে জীবনের মূল্য না বুঝে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়। আবার অনেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও জীবন তার কাছ থেকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। বর্তমানে নিজ ঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা কোথাও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিনই মানুষ কোন না কোন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনেকে আবার অর্থনৈতিক দৈন্যতাসহ বিভিন্ন কারণে জীবনের প্রতি অনীহা এসে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এসব মৃত্যুই অপমৃত্যু হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে সারাদেশে এমন অপমৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এমন একটি দিনও নেই। প্রতিদিনই অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে সব বয়সী মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধের। ট্রেনে কাটা পড়েও মানুষের অপমৃত্যু ঘটছে। এ ছাড়া বিষপানে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে, চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে, ঘুমের বড়ি খেয়ে, শরীরে আগুন দিয়ে এবং নদীতে ঝাঁপ দিয়ে অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আবার কোন কোন ঘটনায় খুন করে আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয়েছে বলে ঘাতক চক্র চালিয়ে দিচ্ছে। এ ধরনের খুনের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রহস্য উদ্ঘাটন হয় না।
হঠাৎ করেই দেখলাম পত্রিকার প্রথম পাতায় সেকেন্ড লিড করা একটি সংবাদ। সেখানে শিরোনাম- প্রাইভেটকারে শিক্ষক দম্পতির লাশ: জমাট রক্ত ছিল কিডনি-ফুসফুসে। সংবাদের ভেতরে যেতে যেতে আরো খারাপ লাগতে থাকে। কেননা, সেখানে উল্লেখ করেছে-
গাজীপুরে প্রাইভেটকারের ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া শিক্ষক দম্পতির মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। মরদেহ দুটির ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া গেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা উল্টালেই উঠে আসে স্বেচ্ছায় জীবন দেয়ার সংবাদ; সেই সাথে স্বামী স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, মা পুত্রকে, পুত্র মাকে, সন্তান বাবাকে, বাবা সন্তানকে, ভাই ভাইকে, বোন ভাইকে, বোন ভাইকে, শিক্ষক শিক্ষার্থীকে, শিক্ষাথী শিক্ষককে, ইমাম মুসুল্লিকে, মুসুল্লি ইমামকে খুনের সংবাদ দেশের বর্তমান কিভাবে চলছে তার রুপ তুলে ধরছে। কিন্তু কেন নির্মম এই খুন-গুমের রামরাজত্ব! গত ১০ বছর আগেও তো এত খুন-গুমের ঘটনা ঘটেনি, অপমৃত্যুও ছিলো না এত। এখন কেন নির্মমতার হাতে সারেন্ডার করছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি সাম্প্রতিক সময়ে।
এমন নির্মমতা থেকে মুক্তি পেতে চায় বাংলাদেশ-বাংলাদেশের মানুষ। তারা চায় না নতুন করে আর একটি মানুষও অপমৃত্যুর শিকার হোক। বড় নির্মমভাবে হত্যার শিকার শিক্ষকদ্বয়ের লাশ দুটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। এ সময় দুজনের ফুসফুস ও কিডনিতে প্রায় একই রকম লক্ষণ পাওয়া গেছে। তাদের দুজনেরই ফুসফুস ও কিডনিতে জমাট রক্ত পাওয়া যায়। এটা সাধারণত খাদ্য বিষক্রিয়া কিংবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। তাই তাদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হতে নমুনার রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লোভ মোহহীন নিরন্তর কাজ করার সুবাদে বলতে পারি- করোনা পরিস্থিতিতে অপমৃত্যু যেন মহামারির চেয়েও ভয়ংকর হয়ে এসেছে বাংলাদেশে। বর্তমানে নারীরা যৌতুক, স্বামীর পরকীয়াসহ দাম্পত্য কলহের জের ধরে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। চলমান সময়ে হাজার হাজার মামলা মুলতবি থাকার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ভিসেরা রিপোর্ট না পাওয়া, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন গৃহীত না হওয়া ও হিস্টোপ্যাথিক।
অর্থনৈতিক মন্দা, দেশে অস্বাভাবিকভাবে বেকারত্ব বৃদ্ধি, বিষণœতা, অস্থিরতা, মাদকাসক্তি, পারিবারিক অশান্তি, যৌতুকসহ মানসিক রোগের কারণেই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এ ধরনের প্রবণতা কারও মধ্যে দেখা দিলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের দেশে টিনেজারদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তাদের এই সমস্যা থেকে বের করে আনতে হবে। সেই সাথে মনে রাখতে হবে- সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। একটি মৃত্যুর সঙ্গে একটি স্বপ্নেরও অপমৃত্যু ঘটে। নারী, শিশুসহ সব বয়সী ও শ্রেণী-পেশার মানুষ প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও আহত ও স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণের হারও কম নয়। আকাশ-সড়ক- রেল ও নৌপথ দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে দেশের একমাত্র স্বেচ্ছাসেবি ও গবেষণা সংগঠন সেভ দ্য রোড অবশ্য বলছে- অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক ও দুজনের অধিক চলাচলের কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে শুধু আমাদের পরিবহন ব্যবস্থাই দায়ী নয়, আমরা নিজেরাও দায়ী। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হলেও তার কার্যকারিতা অনেক কম। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত আইন থাকলেও তা অনেক দুর্বল। আবার যা আছে তারও যথাযথ প্রয়োগ নেই। দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যুগোপযোগী আইনের অভাব, অপরিকল্পিত সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, সড়ক-মহাসড়কের পাশে হাট-বাজার, পর্যাপ্ত ট্রাফিক ব্যবস্থার অভাব, অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ব্যবহার, সড়ক-মহাসড়কে অতিরিক্ত বাঁক, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইলফোনে কথা বলা বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, এ কারণে বাড়ছে অপমৃত্যু। অপমৃত্যুরোধে দেশে সাধারণ মানুষকে যেমন সচেতন হতে হবে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে রক্ষার জন্য নিবেদিত হতেও হবে সরকারকে। যাতে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ ভালো থাকে, দুবেলা-দুমুঠো ভাত তারা খেয়ে বাঁচতে পারে। সেই সাথে তাদের নিত্যদিনের পথচলায় পথকে দুর্ঘটনামুক্ত রাখতে পথ আইনকে কঠোর করতে হবে...