কেউ মারা গেলে আমরা নামের প্রথমে মৃত অথবা মরহুম শব্দ লিখি। কিন্তু মানুষ মরে না। পরিচিত অপরিচিত, আত্মীয়স্বজন ও ভক্তদের মাঝে সে বেঁচে থকে বহুকাল। উন্নত বিশ্বে প্রয়াত মানুষের নামের প্রথমে ‘মৃত’ শব্দ লেখা হয়না। কারণ মৃত লিখলে সেটি নামের অংশ হয়ে যায়। তাছাড়া ধর্মীয় দৃষ্টিতে মানুষের দেহ নশ^র, আত্মা অবিনশ্বর। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বস্তুর বিনাশ নেই, রূপান্তর ঘটে মাত্র। দেহতাত্মিক দৃষ্টিতে অক্সিজেনের অভাবে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমাদের স্বজনরাও কেউ মরে নাই, স্মৃতিতে বেঁচে আছেন এখনো, ছায়ার মতো চারপাশে অবস্থান করছেন সর্বক্ষণ।
চলনবিলের ট্র্যাজেডির ঘটনা প্রায় চার বছর হতে চলল। গত ৩১ আগস্ট’ ১৮ তারিখে চলনবিলে নৌকাভ্রমণে গিয়ে এক নৌকাডুবিতে পাঁচ জনের অকাল মৃত্যু ঘটে। তারা হলেন রফিকুল ইসলাম স্বপন (৩৫),তার কন্যা সৌদামনি (১২),বিল্লাল গনি (৫৫),তার স্ত্রী মমতাজ পারভীন শিউলি (৪৬) এবং আমার সহধর্মিনী শাহনাজ পারভীন পারু (৪৮)। আমাদের দাম্পত্য জীবন ছিল প্রায় ২৫ বছর। এই চার বছর প্রতিদিন কোনো না কোনো ঘটনায় তার কথা মনে পড়ে। তার হাসিমাখা মুখটি আমাকে আপ্লুত করে। একইভাবে বিষাদমাখা মুখটি আমার মনে বেদনা সৃষ্টি করে। আমার বিশ^াস একই অনুভূতি নিয়ে বেঁচে আছেন স্বপনের স্ত্রী মুসলিমা ও বিল্লাল গনির কন্যা ইশরাত জাহান শর্মীও।
মহাবিশে^র বয়সের তুলনায় মানুষের জীবন অত্যন্ত ক্ষণকাল। মানুষের জীবন যতোই সংক্ষীপ্ত হোক না কেন,কেউই অকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চান না। সেজন্য কোনো দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে আমরা শোকাতুর হই,সহানুভূতি প্রকাশ করি। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার,রেলে কাটা পড়ে ১ হাজার,পানিতে ডুবে ১৫ হাজার,হত্যা-আত্মহত্যায় প্রায় ৩ হাজার মানুষ মারা যায়। আমরা পত্রিকায় এসব মৃত্যুর ঘটনা পড়ে সংখ্যা দিয়ে বিচার করি। কিন্তু স্বজন হারানো মানুষগুলো বুঝতে পারেন প্রিয়জন হারানোর ব্যাথ্যা কত কষ্টদায়ক। সামান্য অসতর্কতায় যে কোনো সময় একটি দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। গত এক মাসে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। গত ২৯ জুলাই দুপুরে চট্রগ্রাম মিরেরসরাই খৈয়াছড়া ঝরণা থেকে গোসল করে একদল পর্যটক মাইক্রোবাসে ফিরছিলেন। মাইক্রোবাসটি রেললাইনের গেট খোলা পেয়ে ঢুকে পড়লে চট্রগ্রামমুখী প্রভাতী এক্সপ্রেসের নিচে চাপা পড়ে ১১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে (জানা গেছে,গেটম্যান ওইসময় গেট অরক্ষিত রেখে জুমার নামাজে গিয়েছিলেন)। আরেকটি ঘটনা ঢাকার। জসিমউদ্দীন রোডে নির্মাণধীন ফøাইওভারের কংক্রিটের গার্ডার একটি চলন্ত প্রাইভেট কারের উপর পড়লে গার্ডারে পিষ্ট হয়ে তৎক্ষনাৎ পাঁচজনের মৃত্যু ঘটে। গুরুতর আহত হন দুইজন। তারা একটি বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে আশুলিয়ার দিকে ফিরছিলেন। তবে কোনো কোনো দূর্ঘটনা দ্রুত ঘটে যাওয়ার কারণে মানুষের স্মৃতির আড়ালে চলে যায়। আবার কোনো কোনো দূর্ঘটনা পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে মানুষের মনে গভীর বেদনা (ট্র্যাজেডি) সৃষ্টি করে। চলনবিলের দূর্ঘটনাটি তাদের মধ্যে একটি।
এটা অনস্বীকার্য্য যে, বর্তমানে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হয়ে যাওয়ায় পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের জীবন উপভোগ্য করতে আনন্দ-ভ্রমণের প্রয়োজন পড়ে। একই কারণে আমরা সেদিন চলনবিলের বিশাল জলরাশি শুধু দেখা নয়,বিল অতিক্রম করে তাড়াশ পর্যন্ত যাওয়ার সিদ্বান্ত নেই। কথা ছিল,তাড়াশে যাত্রা শেষ করে সড়কপথে বনপাড়া হয়ে ঈশ^রদী ফিরে আসা। সেই মোতাবেক আমরা মোট ২৫ জন চরভাঙ্গুড়া থেকে যাত্রা শুরু করে তাড়াশ বাজারে পৌছাই। সেখানে এক হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নৌকায় ফিরে আসি। নৌকার মাঝিকে বলি তারা যেন নিকটস্থ বিশ^রোডে নামিয়ে দেয়। অবশ্য আমাদের মধ্য থেকে দুইজন সড়কপথে ঈশ^রদীর দিকে রওনা দেন। বিশ^রোডের নিকট এসে আমরা একটি সমস্যায় পড়ে যাই,তাহলো-নৌকাযাত্রীদের মধ্যে মজিদের স্ত্রী জলি বেগম হলেন বাতজ¦রের (আর্থাইটিস) রোগী। সেকারণে তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। ভ্রমণে তার যাওয়ার কথা ছিল না, নবম শ্রেণী পড়-য়া কন্যার প্রতি অস্বাভাবিক ভালোবাসার টানে তিনি সঙ্গী হয়েছিলেন। তিনি উ”ু রাস্তায় উঠতে পারবেন না বলে জানালে পুনরায় চরভাঙ্গুড়া ফিরে আসার সিদ্বান্ত নেন কুষ্টিয়ার সাইদুর। নৌকাটি হান্ডিয়ালের কাটাখালে একটি পাকের মধ্যে পড়ে তলিয়ে যেতে থাকে। নৌকাটি ছিল স্টিলের তৈরি। ফলে ৩০-৪০ সেকেন্ডর মধ্যে তলিয়ে যায়। আমি আমার ৭ম শ্রেণী পড়-য়া কন্যাকে ভাসিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি। চারদিকে বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদ। সেদিন ছিল হাটবার। পুরুষ মানুষেরা বাড়িতে না থাকায় শাহানাজ, আসমা নামে দুইজন নারী ও সুমন নামে একটি কিশোর তিনটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ভাসমান যাত্রীদের উদ্ধার করে। পরে শুনেছি,বিল্লাল গনি তার কন্যা শর্মীকে উদ্ধারকারী নৌকায় তুলে দিতে পারলেও নিজে ডুবে যান। স্বপন তার কন্যার কাছাকাছি গিয়ে নিজে তলিয়ে যায়। তার কন্যা সৌদামনিও তলিয়ে যায়। আমার স্ত্রী শাহানাজ পারভীন পারু ও বিল্লাল গনির স্ত্রী মমতাজ পারভীন ছৈয়ের ভিতর আটকে পড়ায় ডুবন্ত নৌকা থেকে বেরুতে পারেন নি। দূর্ঘটনার খবর শুনে ঈশ^রদী থেকে দুই শতাধিক ব্যক্তি ঘটনাস্থলে ছুটে যান, শতশত গ্রামবাসী লাশ তোলার জন্য পানিতে ঝাপিয়ে পড়েন, মিডিয়া খবরটি বার বার প্রচার করতে থাকে। এরপর ঈশ^রদীবাসী এ ঘটনাটির নাম দিয়েছে ‘চলনবিল ট্র্যাজেডি’। নৌকাযাত্রীদের মধ্যে কবি-সাহিত্যিক, গবেষব, কলাম লেখক, গায়ক সহ সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরা ছিলেন। তারা ইচ্ছে করলে ‘ঘটনাটি নিয়ে একটি কবিতা অথবা একটি গান লিখতে পারতেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেদিনকার কুষ্টিায়র ভ্রমণসঙ্গীরা কোনো শোকসভায় যোগ দেননি। নিজেরাও কোনো স্মরণসভা করেননি। সেদিনকার ঘটনায় নিজেকেও দোষী মনে হয় বার বার। কেন নিজে নৌকা বাছাই করলাম না, কেন দুটি নৌকা ভাড়া করলাম না, কেন বিশ^রোডে জোর করে জলি বেগমকে নামালাম না ইত্যাদি ভাবনা পীড়া দেয় সর্বক্ষণ। হয়ত এই মর্ম যাতনা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে সারা জীবন।
লেখক : সেদিনকার নৌকাযাত্রী ও কলাম লেখক।