জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নানা প্রাকৃতিক ঝুঁকিতে পড়েছে সারা বিশ্ব। সেসঙ্গে বাংলাদেশেও এর প্রভাব শুরু হয়েছে। বিশেষ করে অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন এবং শীতের সময় গরম এবং গরমকালে অতিমাত্রায় দাবদাহ। এই বৈরী আবহাওয়ায় সাধারণ মানুষ যেমন অতিষ্ঠ তেমনি কৃষিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরের ভারতের মেঘালয় সীমান্তের গারো পাহাড় এলাকার শেরপুরের কৃষি ও কৃষক এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
শেরপুর পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র বেষ্টিত এবং ভারতের পাহাড়ি নদী মহারশি, ভোগাই, চেল্লাখালি, সোমেশ্বরী, মালিঝি, নিতাই, মৃগী, দশানীসহ মোট ১৬টি নদী ছিল। কালের চক্রে এসব নদীর মধ্যে বর্তমানে ৮টির অস্তিত্ব মেলে। এসব নদী তীরবর্তী এলাকায় একসময় কৃষকের সোনালি দিন ছিল। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ওই সব এলাকার কৃষি ও কৃষকের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। হুমকির মুখে পড়েছে কৃষক।
শেরপুরের ৮০ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। জেলাটি বরাবরই ধান বা খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে পরিচিত। গত ২০ বছর ধরে ধানের সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে বিভিন্ন সবজি ও ফল উৎপাদন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জেলায় বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব পড়েছে এই কৃষিতে। একসময় জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদে প্রতিবছর বন্যা হলে নদী তীরবর্তী জমিতে পলি পড়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পেত। বোরো আবাদ ছাড়া অন্য কোনো ফসল বা সবজি উৎপাদনে বাড়তি কোনো সেচ বা পানি দেওয়ার প্রয়োজন হতো না। বন্যাপরবর্তী সময়ে নদ-নদীতে এবং বর্ষা মওসুমে বৃষ্টির কারণে মাঠে-ঘাটে, খালে-বিলে প্রচুর পানি থাকতো। সেই পানিতেই কৃষকরা তাদের আমন, পাটসহ বিভিন্ন সবজি ফলাত। পাট পচাতেও পানির জন্য চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু আবহাওয়ার বৈরী প্রভাবে এবার উল্লেখযোগ্য বন্যা হয়নি। বৃষ্টি নেই বললেই চলে। প্রতিবছর বৃষ্টির পানিতে আমনসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ করা হলেও এবার দেওয়া হচ্ছে সেচ। এদিকে তেলের দাম বৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ে বাড়তি সমস্যা যোগ হয়েছে।
শেরপুর সদর উপজেলার চর শেরপুর ইউনিয়নের দরিপাড়া গ্রামের কৃষক চান মিয়া, আকমল হোসেন ও কেরামত আলী বলেন, ‘আমরা ৩০ বছরের মধ্যে দেখি নাই আবহাওয়ার এই অবস্থা। বৃষ্টি নাই, খালি খরা চলতাছে দুই মাস যাবত। এই সময় আমরা বন্যার আতঙ্কে থাকতাম। কিন্তু বন্যা তো দূরের কথা, একটু বৃষ্টি নাই। আমরা এবার শেষ।’ চর মুচারিয়া ইউনিয়নের মুন্সির চর গ্রামের নূর রহমান ও মো. সুলতান মিয়া বলেন, ‘এবার পাটের আবাদ ভালোই হইছে। কিন্তু পাট জাঁক দেওয়ার কোথাও পানি নাই। ৪ হাজার টাকায় একটি মরা খাল ভাড়া নিয়া তার মধ্যে মেশিন দিয়া পানি দিতাছি। ওইখানে পাট জাঁক দিমু।’
কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, জেলার সর্বত্র যেভাবে আমন আবাদে সেচ দেওয়া হচ্ছে তাতে আগামী বোরো মওসুমে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাবে।এতে বিরাট সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া কৃষকের মাথায় যোগ হবে বাড়তি খরচ।
শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ড. সুকল্প দাস বলেন, সারা বিশ্বের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে।এর প্রভাবে শেরপুরেও এবার দেখছি ভরা বৃষ্টির মওসুমেও বৃষ্টি নেই বললেই চলে। ফলে এবারই প্রথম শেরপুরের কৃষকরা ব্যাপকভাবে সেচের মাধ্যমে আমন আবাদ করছে। শুধু ধানই নয়, পাটের ক্ষেতেও এর প্রভাব পড়েছে।