এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীরা প্রথম দিন যেভাবে ভোগান্তি সহ্য করেছে জ্যাম-পরিবহন সংকটসহ বিভিন্ন কারণে, দ্বিতীয় দিন তা হয়তো আর সহ্য করতে পারবে না ভেবে বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেয়নি; নাকি অন্য কোন কারণ আছে? প্রশ্নটি বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদের কাছে করার পর তাদের সাদামাটা উত্তর অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিভিন্নভাবে ব্যস্ত হয়ে গেছে। মেয়ে হলে বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে হলে কোথাও না কোথাও কাজে যুক্ত হয়ে গেছে। প্রথমদিনের পরীক্ষা ভালো না হওয়ায় আর দ্বিতীয় দিন যায়নি পরীক্ষার হলে। তবে ইতিহাস বলছে- শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্ররোধে তখনও অবিরাম নিবেদিত ছিলো ছাত্র সমাজ। যেই ইতিহাস সৃষ্টির জন্য ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ৬৬’র ছয় দফা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় গভীর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সেদিন ছাত্রসমাজই পালন করেছিল নতুন ইতিহাস নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা, যার ধারাবাহিকতা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এবার এসএসসি-সমমান পরীক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চাওয়া ব্যতিত আমাদের যে আর কিছুই করার নেই। কেননা, আমাদের তাদের অর্থনৈতিক আলোকিত আগামীর নিশ্চয়তা দিতে পারিনি।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই শিক্ষার্থীদের ঝরে পরা রোধ করার জন্য ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এ দেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পুলিশের গুলিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না মোস্তফা ওয়াজিলস্নাহ, বাবুলসহ শিক্ষাধিকার রক্ষার জন্য নিবেদিত শহীদদেরকে। যারা সেদিন ঢাকার রাজপথে আহত হয়েছিলেন, তাদেরকেও ভুলে যাওয়া যাবে না। বরং শিক্ষা ধ্বংনের সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। সবাইকে এখন জাগতে হবে সুশিক্ষার জন্য, শিক্ষিত জাঁতি হিসেবে বিশে^র বুকে খুন-গুম-ধর্ষণ- নৈরাজ্য-অপরাধ-দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সম্মান বাড়ানোর জন্য। শুধু উন্নয়নের রোল মডেল নয়; আমরা চাই সুশিক্ষিত হোক বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ; শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক ৫৬ হাজার বর্গমাইল। এটাই আমার মত সচেতন নাগরিকদের প্রত্যাশা। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, আমাদের আমলা-মন্ত্রী-শিক্ষা ভবনে কর্মরতদের একটি অংশ শিক্ষাকে নিয়ে মরণ খেলায় মেতেছে। তাদের এসব খেলা দেখে প্রশ্ন উঠছে- আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কারা ধ্বংস করছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এসএসসি পরীক্ষার দিন শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির সংবাদের দিকে চোখ রাখলেই বুঝতে পারবেন। অথবা সাম্প্রদিক সময়ে শিক্ষকদের উপর হামলা, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনা দেখলেই বোঝা যাবে। তার উপর আবার একটি ঘটনা বেশি বেশি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো- ২০১৫ সালের পর থেকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সরাসরি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিয়ে আসছেন।
এনটিআরসিএ’র পরিপত্রের ৩ নম্বর কলামে বলা হয়েছে ‘কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি ২২ অক্টোবর ২০১৫ বা তৎপরবর্তী সময়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে কোনো পদে নিয়োগ প্রদান করেন, তা হলে তা অবৈধ নিয়োগ বলে বিবেচিত হবে।’ এই পরিপত্রের সব বিধি উপেক্ষা করে প্রায় কোটি টাকার বিনিময়ে কলেজের গভর্নিংবডির সভাপতি, অধ্যক্ষ, ডিজির প্রতিনিধি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গোপনে পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মো. আবদুল মতিন লষ্কর বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে কোনো বেসরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। এখন কী উদ্দেশ্য নিয়ে ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছিল তা আমার জানা নেই। তবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (শিক্ষা) দপ্তর থেকে বিষয়টি অবগত করার জন্য আমাকে জানানো হয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ ডিজির প্রতিনিধি চিন্ময় বাড়ৈ বলেন, ‘আমি যতদূর জানি বৈধভাবেই নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার কাছে বিষয়গুলো গোপন করেন। যেহেতু নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে আর্থিক লেনদেনের প্রশ্ন উঠেছে তাই ডিজির প্রতিনিধি হিসাবে আমি পরীক্ষার কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করলাম।
ইতিহাসের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলতে চলতে ১৩ বছরের পথচলায় বর্তমান সরকারের আমলে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে, যাতে শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে কিন্তু অন্যান্য শিক্ষা রিপোর্টের মতোই ছাত্রসমাজ তথা জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন তাতে ঘটেনি। যেকোনো নীতি প্রণয়নে ও তা বাস্তবায়নে প্রতিফলন থাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তথা সরকারের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের। সব সরকারই মুক্তবাজার অর্থনীতির দর্শনকে ধারণ করে ধনিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে নীতি প্রণয়ন করে, যার মধ্যে শিক্ষানীতি অন্যতম। সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সার্বজনীন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রতিটি সরকারের আমলেই তা হয়েছে উপেক্ষিত। এই উপেক্ষা থেকে মুক্তির জন্য নতুন প্রজন্ম প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতোকত্তর শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ ও পাঠ্যপুস্তক চায়, প্রথম শ্রেণির নাগরিকত্বের স্বীকৃতি চায় আমাদের ত্যাগী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য।
শুরুর ঘটনা আবারো চলুন দেখে আসি- অতিগোপনে মিঠাপুকুরের বেসরকারি শুকুরের হাট ডিগ্রি কলেজে ৫ জন শিক্ষক নিয়োগে পরীক্ষার আয়োজন ভেস্তে গেছে। পরীক্ষা কেন্দ্রে সাংবাদিকরা জড়ো হওয়ার পর অজানা আশঙ্কায় তড়িঘড়ি করে ৩০ মিনিটের পরীক্ষা ১৫ মিনিট না যেতেই শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজির প্রতিনিধি অধ্যাপক চিন্ময় বাড়ৈ পরীক্ষা বাতিল করেন। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ বিধি উপেক্ষা করে এই কলেজের শিক্ষক নিয়োগে কোটি টাকা হাতবদলের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে ওই বিজ্ঞপ্তি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। শুকুরের হাট কলেজে পর্যাপ্ত জায়গা থাকার পরও সেখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজে ১৫ জন পরীক্ষার্থীর বসার আয়োজন করা হয়। তারপর? তার যা হয়, তা হলো- নিয়োগ পরীক্ষা কেন বাতিল করা হলো এ সম্পর্কে শুকুরেরহাট ডিগ্রি কলেজের (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ গোলজার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, নিয়োগ কার্যক্রম চলার সময় সাংবাদিকরা হঠাৎ করে সেখানে হাজির হন। উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতে নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করেন ডিজির প্রতিনিধি। জানতে চাইলে কলেজের গভর্নিংবডির সভাপতি মিঠাপুকুর উপজেলা যুবলীগ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সেলিম মন্ডল বলেন, কোনো আর্থিক লেনদেন হয়নি। যদি কেউ বলে থাকে তা সঠিক নয়। তা হলে শিক্ষক নিয়োগ বিধি-বিধান বা পরিপত্রের নির্দেশনা উপেক্ষা করে গোপনে কেন এই নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এর কোনো জবাব দিতে পারেননি তিনি। এই বর্তমানে এসে আমাদের দেশে শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। এই দেশ স্বাধীন হওয়ারও অনেক আগে ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ক্ষমতা দখলের ২ মাসের মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষা সচিব এসএম শরিফকে প্রধান করে শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে ২৪ অধ্যায়ে বিভক্ত বিশাল শিক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। রিপোর্টের অধিকাংশ সুপারিশ গ্রহণ করে সামরিক সরকার তা বাস্তবায়ন শুরু করলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সৃষ্টি হয় একের পর এক ইতিহাস। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের শুরু থেকেই ছাত্রদের শক্তিশালী প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র সংগঠনগুলো এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রাজপথে নামে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপি হরতাল আহ্বান করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে দেশব্যাপি সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সে দিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল। কি নির্মম মানচিত্র? এই মানচিত্রের চারপাশে শিক্ষা নিয়ে ষড়যন্ত্র; যে ষড়যন্ত্রর হাত থেকে কোনভাবেই মুক্তি সম্ভব হচ্ছে না। বরং বাংলা, আরবী, ইংলিশ, উর্দুসহ বিভিন্ন ধরণে শিক্ষায় হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ছাত্র-যুব-জনতার সারাজীবনে। শিক্ষা ধ্বংসে ওঁৎ পেতে থাকা প্রেতাত্মাদের রুখতে হবে এখনই।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পর এসে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গীকার ছিল গণমুখী, সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের। স্বাধীনতার ৪০ বছর এবং ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের ৫০ বছর পরও এদেশের ছাত্রসমাজকে শিক্ষার অধিকার আদায়ে নিরবচ্ছিন্ন লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ’৭৫-র পরবর্তী প্রতিটি সরকার ‘টাকা যার শিক্ষা তার’ এই নীতির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পালন করে গেছে অগ্রণী ভূমিকা। উত্তরণ প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের প্রতিটি প্রতিনিধির জন্য। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, যার অনিবার্য পরিণতিরূপে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, তেমনিভাবে বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রসমাজ সর্বগ্রাসী শিক্ষা সঙ্কট উত্তরণে রচনা করবে ছাত্র গণআন্দোলন, যা বেগবান করবে সমাজ বিপ্লবের লড়াইয়ের সমাপ্তি চাই, চাই কথায় কথায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেয়ার কারিগর-ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে মুক্তি। তা করতে না পারলে হয়তো আরো অসংখ্য শিক্ষককে গলায় জুতোর মালা পরিয়ে অপমান করা হবে, অসংখ্য শিক্ষার্থীকে ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে পরে আত্মহূতি দিতে হবে...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি