বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন বাংলার মাটিতে তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোন নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। তত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি কোন নির্বাচনে যাবে না। দলীয় সরকারের অধীনে নিরর্বাচন হলে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচন যদি হতে হয়, তবে তত্বাবধায়ক সরকারের অধিীনেই হতে হবে। তত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এদেশে কোন নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নাম উল্লেখ করে বলেন, ওবায়দুল কাদের বলেন তত্তাবধায়ক সরকার দিবা স্বপ্ন। হাসান মাহমুদ, রাজ্জাকরা বলেন, তত্তাবদায়ক সরকার হবে না। তত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতির বিরুদ্ধে তাদের এসব বলার কারণ হলো, তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা কোনদিনও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ২০টির অধিক সিট পাবে না। একারনে তারা তত্বাবধায়ক সরকারকে ভয় পায়। আওয়ামী লীগ পর পর তিন বার জনগণের ভোট লুট করে, দিনের ভোট রাতে করে ক্ষমতায় এসেছে। জনগণের দাবী ও আন্দোলনের মুখে সংসদ ভেঙ্গে তত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে এবং সেই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অবিলম্বে জনগণের দাবী মেনে নিয়ে তত্বাবধায়ক সরকার পূনঃপ্রতিষ্ঠিত করে জনগণের রুদ্ররোষ থেকে বাঁচুন।
তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, দশ টাকা কেজি চাল, বিনা পয়সায় সার, ঘরে ঘরে চাকুরী দেয়ার কথা বলে ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের সাথে তামাশা করছেন। বর্তমানে ঘরে ঘরে এখন লক্ষ লক্ষ যুবক বেকার। শিক্ষকতার চাকুরী পেতে বিশ লাখ, কনষ্টেবল ২৫ লাখ, চৌকিদার - দফাদার বারো লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। একরাতে পেট্রোল, ডিজেল, কোরোসিনের দাম বেড়েছে ৫৪ ভাগ। তা ছাড়া চাল, ডাল, সবজির দাম আকাশ চুম্বি। সব কিছুর দাম এখন হাতের নাগালের বাইরে। দ্রব্যমূল্য এবং জিনিসপত্রের দাম কমানোর দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ভোলা, নারায়নগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে শাওন সহ নিহত হয় চার নেতা-কর্মী। গোটা পৃথিবী জানে বাংলাদেশে আজ মানবাধিকার নাই, আইনের শাসন নাই। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ
নয়। খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে। অথচ একই মামলায় অন্যান্যের মুক্তি দেয়া হয়েছে। তারেক জিয়া ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় আজ নির্বাসিত। অসংখ্য আলেম-ওলামা আজ কারাগারে বন্দি। একই সময়ে যারা ব্যাংক ডাকাতি, মানুষ হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন করেছে, তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। রাস্ট্র নির্মাণ এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে কয়জন অকুতোভয় সৈনিক অবদান রেখে গেছেন, তাদের মধ্যে হান্নান শাহ্ অন্যতম। হান্নান শাহ্ দেশের চরম দূর্দিনে, পার্টির চরম দূর্দিনে হান্নান শাহ্ ছিলেন কান্ডারী। হান্নান শাহ্ চট্রগ্রাম থেকে শহীদ জিয়াউর রহমানের লাশ ঢাকায় এনেছিলেন। তিনি ছিলেন ১/১১ এর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। তিনি ছিলেন আমাদের উজ্জ্বল নক্ষত্র ও প্রেরণার বাতিঘর। ওনার মতো মহান নেতার কবর জিয়ারত করতে পেরে আমি ধন্য।
তিনি শুক্রবার বিকালে গাজীপুরের কাপাসিয়ার কৃতিসন্তান ও বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য প্রয়াত নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত আ স ম হান্নান শাহ্’র ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঘাগটিয়া চালা ওয়েলফেয়ার ক্লাব মাঠে আয়োজিত দোয়া ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। হান্নান শাহ্ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ও গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি একেএম ফজলুল হক মিলন।
কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আজিজুর রহমান পেরার পরিচালনায় অন্যান্যের মাঝে বক্তব্য রাখেন গাজীপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি হান্নান শাহ্ পুত্র শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজ, কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও নরসিংদী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকন, কেন্দ্রীয় নেতা কামরুজ্জামান রতন, বেনজির আহমেদ টিটু, ওমর ফারুক সাফিন, গাজীপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক বিশিষ্ট শিল্পপতি সোহরাব উদ্দিন, গাজীপুর জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক সাংবাদিক রাশেদুল হক, বিএনপি নেতা মাষ্টার হুমায়ূন কবির, শাহজাহান ফকির, হেলাল উদ্দিন, ড. অ্যাডভোকেট সাইদুজ্জামান, আ ন ম ইব্রাহীম খলিল, অ্যাড. কাজী খান, আবু তাহের মুসল্লি, মোয়াজ্জেম হোসেন, আকতারুজ্জামান বাবুল, হাসিবুর রহমান খান মুন্না, আতাউর রহমান মোল্লা, জান্নাতুল ফেরদৌসী, ইয়াসিন মোল্লা প্রমূখ। এ ছাড়া প্রধান অতিথি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নেতা-কর্মীদের নিয়ে হান্নান শাহ্’র কবরে ফাতেহা পাঠ এবং রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন।
এ উপলক্ষে তাঁর পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে হান্নান শাহ্’র রুহের মাগফিরাত কামনায় তাঁর গ্রামের বাড়ি ঘাগটিয়াতে কোরআনখানি, মিলাদ, দোয়া ও স্মরণ সভা এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের পুস্পস্তবক অপর্ণসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হয়।
হান্নান শাহ্ ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে সিঙ্গাপুরের র্যাফেলস হার্ট সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আ স ম হান্নান শাহ্ ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঘাগটিয়া ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শের রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
তাঁর বাবার নাম ফকির আবদুল মান্নান শাহ্। তাঁর বাবা ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। হান্নান শাহ্’র স্ত্রীর নাম নাহিদ হান্নান। তাদের এক মেয়ে শারমিন হান্নান সুমি এবং দুই ছেলে শাহ্ রেজাউল হান্নান রেজা ও শাহ্ রিয়াজুল হান্নান রিয়াজ। তাঁর ছোটভাই শাহ্ আবু নঈম মোমিনুর রহমান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জেষ্ঠ্য বিচারপতি ছিলেন।
১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া হান্নান শাহ্ বিভিন্ন সেনানিবাসের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অন্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এইচ এম এরশাদ সরকারের সময় তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। তিনি পার্বত্য চট্রগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার, চট্রগ্রামের মিলিটারি একাডেমির কমান্ডেন্ট, যশোর স্কুল অব ইনফ্রেন্টি এ- টেকটিক্স এর চিফ ইন্সট্রাক্টর, পাকিস্তানের কোয়েটার আর্মি কলেজ অব ইলেক্ট্রিক্যাল এ- মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ইন্সট্রাক্টরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮১ সালে ৩০ মে চট্রগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল সেনাবাহিনীর হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাঙ্গুনিয়া থেকে প্রেসিডেন্টের মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ্। এইচ এম এরশাদ সরকার হান্নান শাহকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। তিনি সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রনালয়ের যুগ্ম-সচিব (এপিডি) ছিলেন।
সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর এরশাদ সরকারের সময়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন হান্নান শাহ। ১৯৮৩ সালে ওই পদ ছেড়ে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপিতে যোগ দেন। বিএনপিতে যোগদানের শুরুতে তিনি ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দলের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হান্নান শাহ্ ১৯৯১ সাল ও ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে গাজীপুর-৪ আসন (কাপাসিয়া) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলে তাকে বিএনপি’র সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়। হান্নান শাহ্কে পরবর্তী বছর অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ কাউন্সিলেও তা বহাল থাকে। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তার এই পদ বহাল ছিলো। তিনি কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যা নদীর উপর ‘ফকির মজনু শাহ্ সেতু’র সফল বাস্তবায়নসহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন।
হান্নান শাহ’র পুরো নাম আবু সাঈদ মতিউল হান্নান শাহ্। তিনি বিএনপিতে যোগদানের পর থেকে আমৃত্যু কাপাসিয়া বিএনপির নিরবিচ্ছিন্ন নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গত ৩ দশক হান্নান শাহ্ নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। একজন সেনা কর্মকর্তা থেকে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা হিসাবে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
বিশেষত, মৃত্যুর আগে গত কয়েক বছর এক ধরনের অচলাবস্থায় নিপতিত হওয়া বিএনপিকে চাঙ্গা করতে ও বিএনপি কথিত ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’ আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন হান্নান শাহ্। এ সময়গুলোতে দলের অন্যতম মুখপত্র হিসাবেও গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বিশেষত বিএনপিপন্থী মহলের অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে।
১/১১ এর কঠিন সময়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে হান্নান শাহ্ বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময়ের সেনাসমর্থীত তত্ত্ববধায়ক সরকার ও দলের সংস্কারপন্থী অংশের ‘কর্মকান্ড ও ষড়যন্ত্র’ এর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের সামনে এসে সাহসী কন্ঠে কথা বলে দেশ-বিদেশে দলের নেতা-কর্মীদের দৃষ্টি কাড়েন তিনি। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে হান্নান শাহ্ বেশ কয়েক বার কারাগারে যান। একইভাবে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলেও তাঁকে কয়েক বার কারাবাস করতে হয়েছে। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে ৩০টির বেশী মামলা ছিলো।