১৯৯৩ সাল চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বাংলাদেশের রূপালী পর্দায় সুপার হিরো হিসেবে যখন র্শীষ স্থান দখল করে সিনেমা প্রেমী সকলের কাছে নন্দিত। তখনই বান্দরবানে মাসুম বাবুল-এর প্রযোজনায় ও এম.এ মালেকের পরিচালনায় দুর্নীতিবাজ সিনেমার সুুটিং এ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। দীর্ঘদিন স্ত্রী সন্তানেরা দূরে থাকায় কারণে হিরোর আহবানে তার ২ শিশু সন্তান ইমা ও জয়কে নিয়ে প্রিয়তমা জাহানারা কাঞ্চন সড়ক পথে পাড়ী জমালেন স্বামীর সাক্ষাতের মননে সুদূর বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাষ বিধিবাম। দিনটি ছিলো শুক্রবার পবিত্র জুম্মার নামাজের পূর্ব মুহুর্তে চট্টগ্রাম জেলাধীন চন্দনাইশের হাশিমপুরে ঘটে যায় একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা। আশপাশের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচরে এলেও তেমন কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় শফিক আহমেদ সাজিব ও তার সহপাঠিরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছেন। আহত জাহানারা কাঞ্চনকে দ্রুত নিয়ে গেলেন চন্দনাইশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। একদিকে ২ শিশুর ক্রন্দন অন্যদিকে আহত জাহানারার অন্তিম মুহূর্ত দিশেহারা উদ্ধারকারীরাও। হাসপাতালে পৌঁছার পর জানা গেলো নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রিয়তমা জাহানারা কাঞ্চন আর নেই। হাসপাতাল থেকে ঢাকার মগবাজারস্থ ইলিয়াস কাঞ্চনের বাসভবন কারিমাস প্লাজায় টেলিফোনের মাধ্যমে সংবাদ প্রেরণ করেন উদ্ধারকারী সাজিব। বাস ভবন থেকে যেকোনো পন্থায় সুটিংরত ইলিয়াস কাঞ্চনের নিকট সংবাদ প্রেরণ করা হয়। ধর্মীয় বিধি মোতাবেক ঢাকায় এনে বনানী কবরস্থানে জাহানারা কাঞ্চনকে সমাহিত করার পর সহধর্মীনির বিয়োগ ব্যথায় হতবিহল অন্যদিকে ২ শিশু সন্তানের চোখের জল। দিশেহারা কাঞ্চন। মাসাধিককাল ভাবনার পর সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন সড়ক দুর্ঘটনারোধে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবেন। সম্রাট শাহ্জাহান তার স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে যেমন নির্মাণ করেছেন তাজমহল তেমনি কাঞ্চন তার স্ত্রীর প্রতি অসীম ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সূচনা করেছেন ‘‘নিরাপদ সড়ক চাই” নামীয় সংগঠন। অনেক নিকট জনের সাথে আলোচনার মধ্য দিয়ে সাংবাদিক মুজতবা সাউদ নামীয় ব্যক্তির উদ্বৃতিতে ‘‘নিরাপদ সড়ক চাই” নামের সংগঠনের সূচনা করেন। যার মূলমন্ত্র নিধারণ করেন প্রয়াত পরিচালক শিবলী সাদিক ‘‘পথ যেন হয় শান্তির, মৃত্যুর নয়” নিরাপদ সড়ক চাই সামাজিক আন্দোলন সংগঠনের আত্মপ্রকাশের বিষয়ে দেশপ্রেমী ইলিয়াস কাঞ্চন তীক্ষ্মতার পরিচয় দিয়ে বিজয়ের মাস ১৯৯৩ সালের ১ ডিসেম্বরকে বেছে নেন। সূচনালগ্নে বেদনাবিধুর অবস্থায় একক কন্ঠে ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ একা বল্লেও পরবর্তীতে তার ভক্তকূল এবং দেশপ্রেমী সমাজসেবীদের সমন্বয়ে “নিরাপদ সড়ক চাই” দেশে নয় শুধু আজ আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত। যার ফলশ্রুতিতে ইতোমধ্যে জাতীসংঘও ‘‘নিরাপদ সড়ক চাই”-এর আঙ্গিকে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের সুদীর্ঘকালের কাঙ্খিত ঝউএ’ং বাস্তবায়নে প্রথম এবং প্রধান শর্ত দিয়েছেন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ৫০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। শতপ্রতিকূল পরিস্থিতি ও প্রতিপক্ষের নানা সমালোচনার পাশাপাশি হুমকির বিপরীতে ইলিয়াস কাঞ্চন পিছু না হটে প্রমাণ রেখেছেন মানুষের জীবন রক্ষার্থে তার অঙ্গিকারের। চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য অগণিত পুরষ্কার পেলেও ২০১৭ সালে সামাজ সেবায় অনন্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন একুশে পদক। পৃথিবীর অনেক বিত্তবান ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাজপরিবারের সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সমগ্র বিশে^ আলোচিত মৃত্যু বৃটেনের প্রিন্সেস ডায়না যা সংগঠিত হয়েছিলো ১৯৯৭ সালের ৩১শে আগষ্ট। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা আজ অনেকেই ভুলার পথে। তবে ইলিয়াস কাঞ্চনের দৃঢ়তা, একাগ্রতা ও সৃষ্ট সংগঠনের প্রতি আন্তরিকতাসহ অনুসারীদের প্রচেষ্ঠায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যু দিবস ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেল “জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস” হিসেবে। যা আজ সরকারি ও বেসরকারিভাবে ২২শে অক্টোবর তার মানে মরহুমা জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যু দিবস ‘‘নিরাপদ সড়ক দিবস” হিসেবে দেশব্যাপী পালিত হচ্ছে। এতে নিরাপদ সড়ক চাই সংশ্লিষ্ট সকলেই গর্বিত। আমাদের পর্দায় জাতির ইতিহাসে কোনো অর্জনই আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তদান ছাড়া অর্জিত হয়নি। যেমনটি ঘটেছে ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে। সরকারের উদ্যোগে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের ফসল সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ জাতীয় সংসদে পাশ হলেও এর কার্যকরী পদক্ষেপ বিন্দুমাত্র ঘটেনি, যা সত্যিই দুঃখজনক। আমি আশা করি ২৯ বছর পূর্বে স্ত্রী বিয়োগ ব্যথায় ব্যথিত হয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন একক কন্ঠে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের যাত্রা শুরু করলেও আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নয় শুধু সারা বিশ্বের জনগণসহ জাতিসংঘ কর্তৃক ‘‘নিরাপদ সড়ক চাই”-এর সাথে সমুচ্চারিত কন্ঠে সোচ্চার। আমার প্রত্যাশা যদি সরকারের সদিচ্ছা এবং কুটনৈতিক প্রচেষ্ঠা থাকে তাহলে ২২শে অক্টোবর শুধু বাংলাদেশেই নিরাপদ সড়ক দিবস নয়, আন্তর্জাতিক নিরাপদ সড়ক দিবসের স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে। এরইমধ্যে দিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারীর ন্যায় অর্জিত হবে বাঙালি জাতির আরেকটি বিশ্বব্যাপী সাফল্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট