সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়ক দিবস সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই যেই মানুষটার কথা স্বরণ করতে হয় তিনি হলেন, বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন এর অগ্রপথিক নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর সড়ক দুর্ঘটনায় তার প্রয়াত স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে তিনি নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনে নামেন। ১৯৯৩ সালের ১লা ডিসেম্বর “পদ যেন হয় শান্তির, মৃত্যু শ্লোগানে প্রতিষ্ঠা করেন দেশের অন্যতম সফল সামাজিক সংগঠন “নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)”। সেই থেকে দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে তিনি ও তার সংগঠন নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
১৯৯৮ সাল থেকে নিসচা ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছিল। ২০১২ সালে ১ অক্টোবর ঢাকার সেগুনবাগিচায় এক সংবাদ সম্মেলনে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি জানায় সংগঠনটি। একই বছর ২৬ আগস্ট থেকে নিসচা গণস্বাক্ষর নেওয়া শুরু করে।
২০১৭ সালের ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে “জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস” হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই থেকে সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ও সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতি বছর ২২ অক্টোবর “জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস” সরকারীভাবে দেশব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর ‘সাবধানে চালাবো গাড়ি, নিরাপদে ফিরবো বাড়ি' প্রতিপাদ্যে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত সরকারিভাবে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত হয়।
প্রতিবছর দিবসটিকে ঘিরে সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে জনসচেতনতা তৈরির বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসে এসব জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হলেও বাস্তব প্রেক্ষাপটে সড়কে প্রয়োগে স্বদিচ্ছার অভাবে সড়কে দুর্ঘটনার চিত্র তেমন বদলায়নি।
ফলে সড়কের মৃত্যুর মিছিল থামছে না। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৫৬৬ টি, এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ২ হাজার ৪৬৩ জন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫১৩ জন। নিহতের সংখ্যা ২০১৮ সালে আরো ১১২ জন বেড়ে যায়।
২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় দেড় হাজার বেড়ে যায়।
২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে সড়কে গাড়ি চলাচল সীমিত থাকার কারণে সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমলেও নিহতের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৯১৮ জন।
চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩ হাজার ৫০২ জন নিহত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১৪ জন।
এসব সড়ক দুর্ঘটান জন্য বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চালকের অসাবধানতার কারণে। বিরামহীন ও দ্রুত গতি, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব, অদক্ষ চালক, লাইসেন্স ও সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করেন সড়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। একজন চালক ৪-৫ ঘন্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা মানা হয় না৷ ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়ে যায়। এজন্য মূলত মালিক পক্ষের ব্যবসায়িক মনোভাব ও সড়কে নিরাপদ সড়ক আইন প্রয়োগে সরকারের কঠোর নজরদারির অভাব দায়ি।
অন্যদিকে বেশির ভাগ জনগণই রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন কিংবা ট্রাফিক আইন মেনে চলেন না। ফলে জনগণের অসচেতনতার কারণে প্রতিদিন সড়কে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটে চলছে।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে যারা আন্দোলন করে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একটি সময়োপযোগী সড়ক পরিবহন আইন করার। দেশের পরিবহন আইন দীর্ঘদির ধরে ১৯৩৯ সালের “বেঙ্গল মোটর ভেহিক্যাল অ্যাক্ট’ এবং ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ২০১০ সালে নতুন সড়ক আইনের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১২, ২০১৩, ২০১৫, ২০১৬ সালে চর দফা খসড়া প্রণয়ন করা হয়।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামলে বিষয়টি পুনরায় সামনে আসে। ঐ বছরের ২০ সেপ্টেম্বর সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কঠোর শাস্তির বিধানসংবলিত একটি নিরাপদ সড়ক আইন জাতীয় সাংসদে পাশ করে। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে সড়ক আইনটি কখনোই পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি।
‘সড়ক পরিবহণ সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ’ এ-সংক্রান্ত কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিল, যেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুন মাসে।
নির্দেশনাগুলো হলো- দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, চালক ও তার সহকারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা।
এসব নির্দেশ যাতে বাস্তবায়িত হয়, তা দেখতে তিনজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক নির্দেশনাগুলোরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে দেশ।
সড়ক দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সমস্যা। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার ফলে অসংখ্য মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্বের অভিশাপ বয়ে নিয়ে দুর্ভিসহ জীবন কাটাচ্ছে। এসব সড়ক দুর্ঘটার ফলে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির বিশাল ক্ষতি হচ্ছে।
সরকারের উচিত সড়ক পরিবহন আইন কঠোরতার সাথে নিশ্চিত করা। সড়ক পরিবহন আইন যথাযথ বাস্তবায়ন ও জনগণকে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা।
সেই সাথে সাধারণ জনগণ, গাড়ির মালিক ও চালকসহ সবাইকে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সড়ক দুর্ঘটনা ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন হতে হবে ও রাস্তায় চলাচলের সময় সেগুলো মেনে চলতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন, ‘নতুন করে গড়ে উঠবে এই বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে, বাংলার মানুষ খেলবে, বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে।‘
আমরাও স্বপ্ন দেখি, আমাদের সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় ‘সড়কে একদিন শৃঙ্খলা ফিরবে, সবাই নিরাপদ সড়ক আইন মেনে চলবে, নিরাপদে সবাই সড়কে চলাচল করবে।‘
লেখক পরিচিতি: ডাঃ মোঃ মিজানুর রহমান চিকিৎসক ও কলামিস্ট ইউনাইটেড হসপিটাল, ঢাকা।