দেশ এখন তিনটি মহাদুর্যোগের কবলে। এগুলো হলো- গণতন্ত্রের সংকট, সুশাসনের ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক মন্দা। এদের মধ্যে প্রথম দু’টি দুর্যোগ দীর্ঘদিনের এবং এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। তবে অর্থনৈতিক মন্দা বেশি দিনের নয়, আর কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব বলে আশা করা যায়। যার মধ্যে রয়েছে কিছুদিন আগে উদ্বোধন হওয়া পদ্মাসেতু। বলা যায়, দেশের অর্থনীতির কপাল খুলে গেছে পদ্মাসেতুতে। এক পদ্মাসেতুই দক্ষিণবঙ্গসহ সারাদেশের হাজারো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত পদ্মাসেতু সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ উন্মুক্ত করে দিয়েছে- মোংলাপোর্ট এবং দক্ষিণের ব্যাণিজ্য শহর খুলনাকেও। মোংলা একটি আন্তর্জাতিক মানের পোর্ট, যা কিনা সারা বিশ্বের সাথে মালামাল পরিবহনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে আরও একটি উচ্চতর মাত্রায় উন্নীত করেছে। তবে এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। মূলত, লুটপাটের কারণে দেশের অর্থনীতি এখন কোণঠাসা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে দেশটি মুক্তিযুদ্ধ করে বিশ্বে বীরের জাতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে, সেই দেশে কিছু অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ড উন্নয়নের সব প্রশংসাকে ভুলুণ্ঠিত করেছে। স্বার্থান্বেষী, দেশপ্রেম বর্জিত কিছু ব্যক্তির অপকর্ম এখন ধিক্কারের তলানিতে এসে ঠেকেছে। তাই বলি, মীরজাফররা এখন অন্য কোনো নামে আমাদের মাঝে বিরাজ করছে। এদের সম্পর্কে আমাদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। আর চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় সুশাসনের ঘাটতি ও গণতন্ত্রের সংকট নিরসনের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করার প্রয়োজন নেই। শুধু সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছাতেই গণতন্ত্র তার সাংগঠনিক রূপ লাভ করতে পারে। সেটি কীভাবে?
আমরা জানি, দেশের সাংবিধানিক স্বীকৃতিতে জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক। তাই সমস্ত সরকারি কাঠামোতে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবেই দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রশাসনিক কাঠামোগুলোকে নিজ দায়িত্বে সচেতন হতে হবে। কার্য সম্পাদনের দক্ষতা বাড়াতে হবে। মাথা ভারী প্রসাশসন যত তার সঠিক পথ খুঁজে পাবে, তত তার ভারী মাথা হালকা হবে। আর পাশপাশি জাগ্রত হবে দেশাত্ববোধ, ঘুষ প্রক্রিয়া বন্ধ হবে, টাকা পাঁচার বন্ধ হবে, অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ হবে। মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে। পচে যাওয়া সমাজ আরোগ্য লাভ করবে, আশরাফ-আতরাফের দূরত্ব কমে আসবে। গণতন্ত্রমনস্ক প্রতিটি মানুষ নিজের অবস্থান থেকে দায়িত্ব-সচেতন হবে। অবাঞ্ছিত বহু ঘটনা তার পথ পরিবর্তন করে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে নর্দামার স্রােতে মিশে হারিয়ে যাবে।
বাঙালি বীরের জাতি, সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে জেগে উঠতে যেমন সময় লাগবে না ঠিক তেমনি হারিয়ে যাওয়া বা হারিয়ে ফেলা ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে গতি পেতে সময় লাগবে না। ভয়ের কোনো কারণ নেই। দেশের স্বাধীনতা আনয়নকারী বীর সন্তানেরা কমে গেছে -সত্য, কিন্তু অস্ত্র জমা দিলেও যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের ট্রেনিং জমা হয়নি। সত্য-মিথ্যা বিশ্লেষণে আমরা ৫০ বছরের অধিক সময় কাটালাম। সত্যের সন্ধান চলছেই। একদিন তা উন্মোচিত হয়ে মিথ্যাকে পরাজিত করবে।
সূর্য ওঠার সাথে সাথে কৃষক লাঙল-জোয়াল কাঁধে চাপিয়ে হালের গরু নিয়ে মাঠে যায় জমি চাষ করতে। কৃষক কোন জমি চাষ দিবে সেটি গরুকে বলতে হয় না। গরুই কৃষকের নির্দেশনা বুঝতে পেরে সে অনুযায়ী জমি চাষে শ্রম দিয়ে যায়। এটি হচ্ছে কৃষক, গরু আর জমিনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। আমরা যদি গণতন্ত্রে ফিরে যাই, তাহলে উপর্যুক্ত তিনটি ব্যবস্থাকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে। জ্ঞান বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হতে হবে, সবার প্রতি সহনশীল হতে হবে, লোভ লালসা মিথ্যা পরিহার করে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সমাজ ও দেশবাসীকে সিক্ত করতে হবে। তাবেই আমরা আশা করতে পারি যে, গণতন্ত্রের সংকট, সুশাসনের ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক মন্দা নামের এই মহাদুর্যোগ আমরা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো। সারাবিশ্ব আবারো আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে।
লেখক: কবি, গবেষক; সভাপতি, চিলাহাটি সমিতি, ঢাকা।