প্রায় আড়াই কোটি মানুষের বসবাস যান্ত্রিক এই ঢাকা শহরে। ঢাকা উত্তর সিটি মেয়রের তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার মানুষ ঢাকা শহরে চলে আসছেন। বিশাল এই সংখ্যাক মানুষের বসবাসের এই শহরে নির্মল বায়ুর বড়ই অভাব। যান্ত্রিক এই শহরে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেয়ার মতো পরিবেশ নেই। এর বড় কারণ- শহরের দূষিত বাতাস। শুধু যে শহরে দূষিত বাতাসেই থেমে আছে পরিবেশ তা-না, সঙ্গে বৃষ্টি দূষণ, শব্দ দূষণ, পানি দূষণের মতো বড় বড় দূষণে জর্জরিত নগরী। ফলে এর প্রভাব পড়ছে বসবাসরত বাসিন্দাদের ওপরে। তারা আক্রান্ত হচ্ছেন নানা রোগে। শহরকে পরিবেশ দূষিত থেকে উত্তরণের পথ থাকলেও, নানা উন্নয়নে সেটি মুখ থুপড়ে পড়েছে। ঢাকা শহরকে সুস্থ পরিবেশে গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন পরিবেশবাদি সংগঠন। বিভিন্ন সময় শহরের দূষণ রোধে তাদের প্রতিবাদ করতেও দেখা যায়। কিন্তু, সুস্থ শহর গড়ে তোলার জন্য তাদের পরিশ্রম ও সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরগুলোকে অবগত করার সুফল কতটুকু দৃশ্যমান হয়েছে, সেটাই দেখার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রায় সময়ই দেখা যায় বায়ু দূষণে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান শীর্ষে। এ খবর স্থান পায় টিভি, অনলাইন মিডিয়ায়। কখনোবা জায়গা হয় প্রিন্ট মিডিয়ায় লিড স্টোরিতে। বায়ু দূষণ রোধে সরকারের সংশি¬ষ্ট দপ্তরগুলো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা রোধ করতে সক্ষম হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বেশিরভাগ সময়ই আমরা নিজেরাই নিজের স্বার্থের জন্য বা উন্নয়নের জন্য পরিবেশের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দূষিত করছি। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণের বড় কারণ হলো- রাজধানীর বর্জ্য। নগরীর অনেক বর্জ্য রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে, কেউবা অনিচ্ছাকৃতভাবে বর্জ্য, প্লাস্টিক যেখানে সেখানে ফেলে দিয়ে রাখছে। সড়কে পড়ে থাকা এসব বর্জ্যগুলোকে একত্রে করে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হলো- যে পরিচ্ছন্নকর্মীরা ঢাকাকে পরিস্কার রাখতে নিয়োগপ্রাপ্ত; তারাও আজকাল বর্জ্য সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) ঝামেলা এড়াতে স্বল্প কষ্টে বর্জ্য সড়কে পুড়িয়ে ফেলছে। ফলে তৈরি হওয়া কালো ধোঁয়া ঢাকার পরিবেশকে আরো বিষিয়ে তুলছে। যা ঢাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিটা আরও বৃদ্ধি করছে।
গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, ঢাকার অন্তত ৬০ টির বেশি স্থানে খোলা আকাশের নিচে বর্জ্য পোড়ানো হয়। যার ফলে ডাইঅক্সিন, ফুরান, মার্কারি, পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইলের মতো বিষাক্ত উপাদান যুক্ত হচ্ছে বাতাসে। এ ছাড়া কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ অন্তত ছয়টি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয় যার ফলে বায়ু দূষিত হচ্ছে।
সুস্থ্য নগরী থেকে দূরুত্ব বাড়ার আরেকটি কারণ হলো- নির্বিচারে গাছ কাটা। দেখা যায়, নগরীর যে জায়গাগুলোতে একসময় সবুজ প্রকৃতি উঁকি দিতো নগরীর বড় বড় দালান কোটার ফাঁক দিয়ে, সেই জায়গাগুলোতে নির্বিচারে গাছ কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পায়ন। সবুজ প্রকৃতি জায়গাগুলোতে শিল্পায়ন গড়ে উঠার কারণে অক্সিজেন সংগ্রহের বড় একটা মাধ্যম গাছ ‘উধাও’ হচ্ছে।
আমরা জানি, বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। দূষণের ফলে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। আমাদের জীবনে এমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে যে, খুব দ্রুত যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা না করা যায়; তবে ভবিষ্যত প্রজন্ম একটি অসুস্থ প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে। বায়ু দূষণ যতই বাড়বে ততই নির্মল বায়ুর অভাবে নিশ্বাস নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। বায়ুদূষণ ভবিষ্যত মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দাঁড়াবে।
গবেষণার এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর জন্য সরাসরি বায়ুদূষণ দায়ী। বায়ুদূষণের ফলে যে শুধুমাত্র আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা কিন্তু নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বায়ু দূষণের ফলে ওজনস্তর পাতলা হচ্ছে। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাঁচ্ছে।
গবেষণার আরেকটি প্রতিবেদন বলছে, নিরব ঘাতক এই বায়ু দূষণের কারণে গড়ে সাত বছর করে আয়ু হারাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। নিরব ঘাতকের কারণে আমাদের যে রোগ হয় সেটা আমরা দ্রুত অনুধাবন করতে পারিনা বলেই আমরা এই বিষয়কে গুরুত্ব দেই না। কিন্তু, সত্য এই যে বায়ু দূষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নিরব এই ঘাতক থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোই মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিরব ঘাতকে বিপর্যস্ত জনজীবনের চিত্র টিভি, অনলাইন, প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত হলেও, এটা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। এর থেকে পরিত্রাণের নূন্যতম সাফল্যের পথ দৃশ্যমান হয় না। বিভিন্ন সময় সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। কিন্তু, সরকারি উদ্যোগের কারণে বায়ু দূষণের মানমাত্রা কমেছে; এমন ঘটনা খুব কমই বলা চলে! বায়ু দূষণ রোধে যেমন জনসচেতনা দরকার, তেমনি দরকার নগরায়নে সুষ্ঠপরিকল্পনা। একটি শহরকে উন্নয়নশীল করার আগে সেই শহরের বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা থাকাটা বেশি প্রয়োজন। তাই দূষণ পরিস্থিতি থেকে কিভাবে বের হয়ে আসতে হবে সেই কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে। প্রচুর বনায়ন করতে হবে। নির্মাণকাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে করতে হবে, যেন সেটি দূষণের কারণ না হয়। শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছেটানোর ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা। অবৈধ ইট ভাঁটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়াতে হবে। এর পাশাপাশি বায়ু দূষণ রোধে দেশের সবাই একত্রিতভাবে কাজ করলেই তবেই আমরা দেশে ও শহরকে সুস্থ্য রাখতে পারবো।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী