মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১নং সেক্টরে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এ অঞ্চলের নিঃষ্পেসিত গণ মানুষের হৃদয়ে গাঁথা এক অবিস্মরনীয় নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খান (বীর প্রতিক)।
তিনি ১৯৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ মাতৃকার টানে ভারতের বিহার চাকুলিযায় সর্ববৃহৎ গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রবাসী সরকারের অধিনে সামরিক প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তি তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালায় মুক্তিযুদ্ধের ১১ নং সেক্টর জেডফোর্সের হেড কোয়াটাররে রিপোর্ট করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তার মেধা ও দক্ষাতার কারণে মেঘালয় রাজ্যের নদী বন্দরে স্থাপিত মানকাচর সাব সেক্টর হিসাবে প্রথম বিভক্ত করে বৃহত্তর রংপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিপরীতে ৫৫০ বর্গমাইল এলাকার সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়েজিত ছিলেন। তিনি রংপুরের কুড়িগ্র্রাম ও গাইবান্ধা পরবর্তি জামালপুর এলাকায় অবস্থিত পাকিস্থান বাহিনীর শক্তিশালী দুর্ভেদ্য সুরক্ষিত ঘাঁটিতে অভিযান পরিচালনা করতেন। তার অসীম সাহসিকতা এবং বীরত্বের কারণে যুদ্ধকালিন সময়ে তাকে স্কোয়াডন লীডার হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসূত্রে জানাযায়,তৎকালিন দেওয়ানগঞ্জ থানার অধিন,বর্তমানে বকসিগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অর্ন্তগত মহেন্দ্রগঞ্জের সীমান্তবর্তি এলাকায় মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১নং সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল। ১১নং সেক্টরের সর্বপ্রথম সেক্টর কমান্ডার(অধিনায়ক) হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। তাই তার নামানুসারে (জেড ফোর্স) নামকরণ করে ১১নং সেক্টরের যাত্রা শুরু করে। মেজর জিয়া মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে ১১আগষ্ট/৭১ পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার(অধিনায়কের) দায়িত্বে থাকাকালে অভিযানে তেমন কোন সফলতা না আসায়, পরবর্তি মিত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দ্দেশে ১২ আগষ্টে/৭১ তাকে বাদ দিয়ে তদস্থলে কর্নেল আবু তাহের(বীর উত্তম)কে ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার (অধিনায়ক) পদে ন্যস্ত করেন। কর্নেল আবু তাহের(বীর উত্তম) তিনি ১১নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে মানকারচর, ছাড়াও মহেন্দ্রগঞ্জ, পুরাকাশিয়া, ডালু, বাগমারা, শিববাড়ী, রংড়া, এবং মহেশখোলাসহ মোট ৮টি সাবসেক্টরে বিভক্ত করেন। জানাযায়,কর্ণেল আবু তাহের তিনি ১২ আগস্ট থেকে ১৪ নভেম্বর/৭১ এ সময়ের মধ্যে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর বিরোদ্ধে কমপক্ষে ১০বার সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। ১৪ নভেম্বর/৭১ ধানুয়া কামালপুর শত্রু বাহিনীর বিরোদ্ধে সর্বশেষ যুদ্ধে লিপ্ত হন। কর্নেল আবু তাহের ঐদিন যুদ্ধে পাকসেনাদের মর্টার সেলের আঘাতে তার বাম পা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায়।
১৫ নভেম্বর/৭১ মিত্র বাহিনীর নির্দ্দেশ ক্রমে উইংকমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খানকে ১১নং সেক্টরের তৃতীয় তম সেক্টর কমান্ডার(ভারপ্রাপ্ত) হিসাবে দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। তিনি ১১নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে ৩ হাজার নিয়মিত বাহিনী এবং ১৯ হাজার গনবাহিনীসহ মোট প্রায় ২২ হাজার মুক্তি বাহিনীর যোদ্ধা নিয়ে পাকহানাদারদের বিরোদ্ধে লড়াই অভিযান শুরু করেন। ৩ডিসেম্বর/৭১ এর বিকালে তিনি মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সদস্যদের একত্রে নিয়ে ধানুয়া কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্পে একযোগে ঘিরে ফেলেন। সেই দিন উইংকমান্ডার হামিদুল্লাহ খানের নির্দ্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ (বীর প্রতীক) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জু (বীর প্রতীক) দু’জন জীবনের মায়া ত্যাগ করে আত্মসমাপন পত্র নিয়ে বীরদর্পে পাকসেনা ক্যাম্পে উপস্থিত হন। পত্র পেয়ে পাকসেনা কমান্ডার গ্যারিসন অফিসার আহসান মালিক অগ্নিমূর্তি ধারন করে দু’জনকে বেধড়ক পিটুনী দিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের শরীরে টাইম বোম লাগিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখেন। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যোদ্ধারা তেলে-বেগুনে জ¦লে উঠে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হন।
সেই রাতে বীরমুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন বীরত্বপুর্ণ লড়াই করে তার দল নিয়ে পাকসেনা ক্যাম্পের মাত্র ৫শত গজ অদূরে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এ সময় তার দলের ওয়্যারলেজ (বেতার যন্ত্রটি) হঠাৎ অকেজু হয়ে গেলে মিত্র বাহিনীর সাথে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের দলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে মিত্রবাহিনীর সদস্যরা ভুলবসত ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনসহ তার দলের উপর পেছন থেকে সেল নিক্ষেপ করতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে সেলের আঘাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন সালাউদ্দিনসহ মোট ৪শ ৯৭জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সে রাতে শহীদ হন। সারা রাত মুক্তি বাহিনীর তোপের মুখে টিকতে না পেরে অবশেষে অবস্থা বেগতিক দেখে ৪ ডিসেম্বর ভোর রাতে পাকিস্থানি গ্যারিসন অফিসার আহসান মালিকসহ মোট ১শ ৬২ জন বেলুচ, পাঠান ও পাঞ্জাবী সৈন্যে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন সালাউদ্দিনসহ যে সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য নিজেদের জীবন উৎসরর্গ করে শহীদ হয়েছেন। জাঁতি তাদের প্রতি যুগ যুগ ধরে চিরকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। সেই বীর শহীদদের স্মরণে যুদ্ধের মাঠ ধানুয়া কামালপুর আজও স্মৃতিস্তম্ভ মাথা উঁচু করে কালের সাক্ষী হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাদের বিদেহী আত্মার প্রতি শান্তি কামনা করে অবনত মস্তকে স্বশ্রদ্ধ ছালাম জানাই।
(এই খানে স্মৃতিস্তম্ভে একটি ছবি সংযুক্ত করতে অনুরোধ করছি)
জনশ্রুতি রয়েছে ৪ডিসেম্বর সকালে ধানুয়া কামালপুর শত্রু মুক্ত হলে বীর মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদ (বীর প্রতীক) এবং সঞ্জু দুই জন লাল সবুজের বিজয়ী পতাকা সর্ব প্রথম ধানুয়া কামালপুরের মাটিতে উত্তোলন করেন। ধানুয়া কামালপুর বিজয়ের পর মুক্তিযুদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ৫ডিসেম্বর বকসিগঞ্জ,৬ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জ,৭ডিসেম্বর ইসলামপুর,৮ডিসেম্বর মেলান্দহ, ১০ডিসেম্বর জামালপুর সদর এবং ১২ডিসেম্বর সরিষাবাড়ি একের পর এক জামালপুর জেলায় শত্রু মুক্ত হতে থাকে। তাই এ অঞ্চলে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখায় বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ নিঃষ্পেসিত গণমানুষের হৃদয়ে অবিস্মরনীয় বীরত্বপূর্ণ একটি লিখা নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খান (বীর প্রতিক)।
উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খান পরিচিতিঃ-তিনি ১৯৩৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার (সাবেক বিক্রমপুর পরগণা) মেদিনীমুলে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দবিরউদ্দিন খান এবং মাতা জসিমুন্নেসা খানের অষ্টম সস্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। এম হামিদুল্লাহ খান ১৯৫৪ সালে লৌহজং এ. টি. ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। জগন্নাথ কলেজে ব্যাচেলর অফ কমার্স কোর্সে দুই বছর পড়া লিখা চলাকালিন ১৯৫৮ইং সালে তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর রিসালপুর একাডেমিতে ৩৪তম জিডিপিতে যোগ দিয়ে আড়াই বছর প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬২ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন। পরবর্তি ১৯৬৫ সালে তিনি রাবেয়া সুলতানা এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ঘর আলোকিত করেছিলেন তিন পুত্র সন্তান। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে এম হামিদুল্লাহ খান পূর্ব পাকিস্থান বিমানবাহিনীর সদর দপ্তরে সহকারি প্রভোস্ট মার্শাল পদে নিযুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পরপর্তি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়ে ১৯৭৮ইং সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। অবসর পর তিনি ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৬- এই তিন মেয়াদে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সদস্য পদ লাভ করে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঢাকা-১৫ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অবশেষে উইং কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খান ২০১১ সালে ৩০ ডিসেম্বর সকলকে সকলকে কাঁদিয়ে মৃত্যুর কুলে ঢলে পড়েন। ঢাকা বনানী এলাকার ২৩ নম্বর সড়কটি তার নামে বর্তমানে নামকরণ করা হয়েছে। তার লেখা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিঃ- দুটি বই রয়েছে (১) 'একাত্তরে উত্তর রণাঙ্গন' (২) 'বাঙালির স্বাধীনতার পটভূমি'।