আমি চা শেষ করে বেরিয়ে এলাম। বাইরে ভীষণ রোদ। আমার শরীরটা জ্বলে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘেমে উঠলাম আমি। ইচ্ছে হচ্ছিল আবার ভেতরে গিয়ে বসি। গাড়িটার দিকে চেয়ে ভয়ঙ্কর রাগ হলো আমার। আর অতো লোক দেখে। ওইরকম মেয়েমানুষ দেখে। বাইরে অসম্ভব রোদ। এত ভীষণ যে, আমি জ্বলে গেলাম ভেতরে ভেতরে আর আগুন ধরে গেল গলায়। আর আমার ঘাম ঝরতে শুরু করলো নাভি থেকে প্যান্টের মধ্যে, ভেতরে আর আমি চিৎকার করে উঠলাম- এই শালা হারামি, এতনা আদমি কাহে লিয়ে। উর্দু বলতেই রাগ ঝাঁ ঝাঁ চড়তে লাগলো। আমি দুপুরের খাবার না খেয়ে খিদে নিয়েই সিগারেট ধরিয়ে গাড়িটির চারদিক ঘুরে সামনের দিকের দরজা দড়াম করে খুলে আমার সিটে গিয়ে বসলাম। বাঁ-হাতে ফার্স্ট ক্লাস সিটে বসা রোগা পুলিশটা দেখে আবার আমার মাথা গরম হয়ে উঠলো। আমি খুব চেষ্টা করে স্টিয়ারিঙে হাত রেখে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম আর সে কিনা বললো- লাটসাহেবদের সময় কি আর হচ্ছে না? সঙ্গে সঙ্গে আগুনের মতো গরম লাগল চোখ দুটোকে। শালা শুয়োরের বাচ্চা আর একটি খুব খারাপ কথা মনে মনে বলে ঠাণ্ডা গলায় বললাম- পুরো ভাড়া লাগবে। সে তখন কেঁউ কেঁউ পেছনের দিকে গিয়ে দাঁত বের করে হাসলে আমিও ওকে আমার কালো ঝিঙের বিচির মতো দাঁত দেখালাম। তখন গাড়ির লোকজন আমাকে ভীষণ তাড়া দিতে লাগলো। কেউ কেউ আমাকে ধমকাতে শুরু করলো আর আমার হাত দুটো কেমন নেতিয়ে পড়লো। মাথা ঝিমঝিম করে ঘুরে উঠল। আমি ভাবলাম, দুপুরের খাওয়া না খেয়েই এমন হচ্ছে। কেন খেয়ে উঠলাম না মনে হতে লাগলো আমার আর মনে হলো, এখন খেতে উঠে গেলে এই হারামির বাচ্চারা আমাকে মারবে। সবারই প্রায় নাকের ডগা লাল দেখলাম। চোখ লাল মনে হলো আর দারুণ মারমুখী মনে হলো। আমি মদের পয়সা রাখতে গিয়ে না খেয়ে বাঞ্চোতের মতো কাজ করেছি; তবু পকেটে পয়সা নিয়ে বসে থাকলাম। আমার ঠিক পেছনে শুয়োরের মতো দেখতে একজন বলে যেতে লাগলো- আমি রহিমপুর থানার অফিসার ইনচার্জ। তখন কেউ বললো, তাহলে স্যার। কেউ বললো বাজারে কেরোসিন নেই; এমনও শুনলাম, কলা চোষো সরকার অনেক কিছু করছে; কাটা কাটা শুনলাম, ঠিক মনে নেই, ভোট নিয়ে করবি কি? তোরা কুকুর-বেড়াল; শালারা কি গাড়ি ছাড়বে না; খরায় ধান মরে যাচ্ছে। ওঃ শালারা, এত বকতে পারে- আমি ভাবলাম, আর ধাই ধাই করে বাসের গায়ে... হারামির পুত কন্ডাক্টর ফটু দু-ঘা লাগাতেই ওইরকম খিদে নিয়ে আমি ইঞ্জিন চালু করে দিলাম। রোদের মধ্যে টপটপ করে প্রাইভেট পার হতে লাগলো। প্রাইভেট, প্রাইভেট, প্রাইভেট, স্কুটার, লরি, প্রাইভেট, ঠেলাগাড়ি, কুকুর-গাড়ি আমি গড়াতে লাগলাম আর স্টিয়ারিঙের ওপর আমার হাত কাঁপতে লাগলো থরথর করে আর আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম। আবার চাকা গড়াচ্ছে মাত্র, গাড়ির গায়ে দুরমুজের মতো এক ঘা পড়লো। গাড়ি থামিয়ে আমি আবার রাস্তা দেখতে লাগলাম। তারপর আবার দু’পা আমি গড়িয়েছি। তখনই এক ঘা পড়লো। আমি রাগে অন্ধ হয়ে থামলাম আর দু’ঘা পড়লো। শালা শুয়োরের বাচ্চা। নামলে তুই শালাকে জানে শেষ করে দেবো, চিৎকার করে ফটুকে বললাম। সেও আমার মতো, না, আমার চেয়ে বেশি, অনেক বেশি ঘামছে দেখতে পেলাম, খিঁচিয়ে উঠে বললো, দেখতা নেহি মাল উঠতা হ্যায়। আমি দরজা খুলে নেমে গেলাম আর আমাকে দেখে অল্প বয়সী কন্ডাক্টর ছোঁড়াটা ভয়ে সিটিয়ে গেল। সে পোকা ধরা দাঁত বের করে অসহায়ভাবে একটু হাসলো আর আমি তার গালে মারলাম। তার চোখের চাউনি ওপরের দিকে উঠে গেল ... আমি তখন তার চুল মুঠো করে ধরলাম আর আবার মারলাম কানের ওপর। হাতে অসম্ভব লাগলো। সেজন্যে স্যান্ডেল খুলতে গেলাম আমি আর দুহাতে আমার হাত চেপে ধরলো সে। আমি দেখলাম তার লুঙ্গি খুলে গেছে। ভেতরটা পরিচিত লাগলো আমার আর স্পষ্ট দেখলাম তার পেটের কালো চামড়া ভেতরে ঢুকে পিঠের সঙ্গে কাগজের মতো সেঁটে গেছে। ওইভাবে প্রায় ন্যাংটো হয়ে শুয়ে শুয়েই ফটু হাত জোড় করলো- ওস্তাদ, পায়ে পড়ি, আর মেরো না। শালা ইয়ার্কি মারছো, শালা হারামখোর... বলে আমি আবার প্যাঁদালাম ওকে। এখন যেন ওকে আমি চিনতে পারছিলাম না। আর একবার মার শুরু করতেই খুবই মারতে ইচ্ছে করছিল। ডালকুত্তার ডাণ্ডা ধরে অ্যাসিসটেন্ট ছোঁড়াটা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এমনি সময় আমার চুলে টান পড়লো। কোনো দিকে আমি ঘাড় ফেরাতে পারলাম না আর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে ওপরের দিকে চোখ তুলে তাকাতে হলো। আমার মাথা থেকে এক ফুট উঁচুতে ফুটবলের মতো বড়, গরুর রানের মতো লাল থলথলে একটা মুখ যেন ফুলে ফুলে আগুনের গোলা হয়ে যাচ্ছিল। আমি চিৎকার করতে গেলাম। আর আমার জানা সমস্ত গালাগালি উগরে দেয়ার চেষ্টা করলাম। ঠিক তার আগেই আমার নাক, মুখ আর কপালের ওপর একটা ঘুষি এসে পড়লো। থ্যাপ করে একটা উঁতো আওয়াজ উঠলো। আমি একটুও ব্যথা পেলাম না। কোথায় একটা ষাঁড় গর্জে উঠলো ঘষঘষে গলায়। রিকশার বেল বেজে উঠলো টিং টিং করে, আরো কি কি ঘটেছিল ঠিক বুঝলাম না। দুপুর জ্বলতে লাগলো। ভয়ঙ্কর পিপাসা পেল আমার। বুকের ভেতরটা আনচান করে উঠলো। বিরাট ওজনের কিছু দিয়ে ধাক্কা দিলে যেমন হয়, তেমনিভাবে আমি ছিটকে পড়ে গেলাম রাস্তার পাশে ফুটপাত পেরিয়ে রুটির দোকানের ভেতরে। তক্ষুনি সেই লোকটা দৈত্যের মতো পা ফেলে ফুটপাত পার হয়ে ভেতরে চলে এল। আমার মাজায় অত্যন্ত ব্যথা হয়েছিল বলে সে যখন আমার বুকের কাছে জামা ধরে টেনে তুললো, আমি উঠতে পারলাম না। কিংবা এমনও হতে পারে যে, আমি দাঁড়িয়ে উঠেই আবার বসে পড়েছিলাম। এজন্য সে যখন আবার আমাকে টেনে তুললো আমার জামাটা ফ্যাঁস করে ছিঁড়ে গেলো। আমি বসে পড়লাম আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মাজাটা কনকন করে উঠলো। সেইভাবে বসে বসে আমি পা দিয়ে লাথি ছুড়লাম। আর লোকটার কোমরের কাছে থুথু ছিটিয়ে দিলাম। এতে বোধ হয় তার অসম্ভব রাগ হলো, কারণ সে আমাকে তক্ষুনি ফুটবলের মতো কিক মেরে দিলো। তখন ফুটপাতের ওপর চিৎ হয়ে আমি সূর্য দেখতে লাগলাম আর সে আমার কাছে এলে তার পা জড়িয়ে ধরে মাফ চাইতে শুরু করলাম। ঠিক এই সময়ে সূর্য জ্বলছে আর শুকনো শরীর লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে। লোকটা আমার দিকে চেয়ে ছিল, সেজন্য কন্ডাক্টর যখন পিছন থেকে ডাণ্ডা তুললো সে দেখতে পেলো না। আমার মনে হলো এখনি আমার মুখের ওপর তাজা গরম রক্ত ছলাৎ করে ছিটকে পড়েছে। ভয়ঙ্কর কষ্টে খিধায় আর পিপাসায় অন্ধ হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম- এই খানকির পুত, খবরদার, মারবি না। ডাণ্ডা নামা শিগগির।
লোকটা প্রথমে মনে করলো তাকে বলছি ... তারপর সে পেছন ফিরে এক ঝটকায় লোহার ডাণ্ডাটা কেড়ে নিয়ে এতোক্ষণ পরে চিৎকার করতে লাগলো, ইস এই শালা আবার ডাণ্ডা এনেছে- দরদ উপচে পড়ছে বাঞ্চোতের। না হোক ছোঁড়াটাকে মারছে বলে নেমে এলাম- উনি আবার ওর বাবার হয়ে ডাণ্ডা নিয়ে লড়তে এসেছে। আরো কি সব ইংরেজিবাংলায় বলে সে আমাকে বললো যা এক্ষুনি গাড়িতে ওঠ, গাড়ি ছেড়ে দে- আর একটি কথা বলবি না। শালা দুধের ছোঁড়াকে মারতে এসেছো। যা। আমাকে চিনিস তো? আমি তাকে চিনতে পারলাম না। তবে বাসসুদ্ধ সমস্ত মানুষ, আশপাশের রাস্তায় লোকজন চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল বলে তাকে চিনতে আমার খুব কষ্ট হলো না।
বহু কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে ধুলো ঝেড়ে আর কষের রক্ত মুছে আমি আবার গাড়িতে স্টিয়ারিঙের পিছনে বসলাম। তখনও কাঁপছিল থরথর করে সমস্ত গাড়িটা। আমার বুকের ডান দিকটা তাড়াতাড়ি ফুলে উঠছিল। ড্রাইভারের দরজার একটু ওপরে ফিট করা আয়নায় একটুক্ষণ আমার মুখটা দেখে নিলাম। ডান দিকটা ফুলছে- কালচে হয়ে আসছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নীল বেগুনে রঙের শিরা দেখা যাচ্ছে আর অসম্ভব জ্বালা করছে। ঠাণ্ডা পানিতে মুখটা ধুয়ে নিতে ভীষণ ইচ্ছে হলো। কিন্তু ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার সামনে দিয়ে যেতে সাহস হলো না আমার বিনা আড়ম্বরে। কাজেই বাস ছেড়ে দিয়ে আমি বাঁদিকের সিটে দু’টো মেয়ের দিকে চাইলাম। তাদের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল ভয়ে কিন্তু তাদের পিছনের সিটে মোটা কাপড়ের ব্লাউজ পরা- খুব সম্ভব বেশ্যা বেশ্যা হবে- একটা আলকাতরার মতো কালো মোটা মেয়েলোক কালো কালো দাঁত বের করে বারে বারে পানের পিক ফেলছিলো।
আমার হাত কাঁপছিল। কোমর টনটন করছিল। এখন একটা চোখে কিছুই দেখতে পারছিলাম না। বাসের ভেতর ফিসফিস আলোচনা আরম্ভ হলো- আর আমি গম্ভীরভাবে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলাম। রাস্তার পাশে ছুটকো প্যাসেঞ্জার বারবার হাত তুলে থামাতে বলছিল- মাছের চুপড়ি নিয়ে জেলেরা হা-পিত্যেশ করে বসেছিল গাছতলায়- কাপড়ের গাঁট নামিয়ে ফেরিওয়ালা গামছা দুলিয়ে হাওয়া খাচ্ছিল। ওরা বাস দেখে থামাতে বলছিল কিন্তু এইসব লাভের খদ্দেরদের দেখে অন্যদিনের মতো দাঁত বের করে হেসে প্যাসেঞ্জারদের আপত্তি কেয়ার না করে আমরা দাঁড়াচ্ছিলাম না। কন্ডাক্টর চুপচাপ করে কোণে দাঁড়িয়েছিল। দরজার কাছে ছোঁড়াটা এক পা ঝুলিয়ে দিয়ে ডাণ্ডা ধরে কিছু যেন ভাবছিল। আমি মেয়ে দুটোর মুখের দিকে আবার তাকালাম। আর দেখলাম তারা আমার দিকে চেয়ে আছে। এত কষ্ট আর অপমান নিয়েও আমি মনে মনে ওদের দুজন সম্বন্ধে খুব খারাপ কথা চিন্তা করলাম এবং তখনি দেখলাম আবার আমার দিকে তারা খুব নরম চোখে চাইল আর ওদের মধ্যে বড়োটিকে আমার মরে যাওয়া বড়ো বোনের মতো মনে হলো। আবার জ্বলতে লাগলো বুক, ক্ষোভে পুড়ে যেতে লাগলো। ক্ষোভ আর অনুশোচনা আসার সঙ্গে সঙ্গে সব ভুলে যেতে শুরু করলাম- যেন ঝিরঝির বৃষ্টি শুরু হলো শুকনো মাঠে। যেন সবুজ ঘাস গজিয়ে উঠল পলি মাটিতে। তখন ছোট বেলাকার আর স্কুলের এবং মরা বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। আর বাসটাও চুপচাপ যেন ভাবতে ভাবতে চলতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে এমনি ওষুধের দরকার ... এই মন্তব্য কানে এলো। ওর নাম রাসু গুণ্ডা। বেশি উচিত বিচিত চলবে না ওর কাছে- এইভাবে ফিসফাস আলোচনা হই হই হয়ে গেল। কন্ডাক্টর ছেলেটা আমার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ালো। এখন ওস্তাদ, রাজু ভাই। আমি তার দিকে তাকালাম। শুকনো কালো বেগুনের মতো শুকিয়ে গেছে তার মুখ, জামা ছিঁড়ে গেছে। চেক কাটা লুঙ্গি, ধুলো-হলুদে দাঁতের ময়লার ওপর কয়লার গুঁড়ো। ওস্তাদ, আবার বলল সে, তার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি ঝরে পড়লো। বাইরে ভীষণ রোদ কিন্তু ছেলেটা চোখের দিকে চোখ রেখে আমার ভারি ঠাণ্ডা লাগল। যা টিকিটগুলো করে নে- আমি বলি; দুপুরে চা মেরে এসেছিস পয়সা বাঁচাতে মরবি যে শালা?
যেখানে এসে দাঁড়ালাম সেখান থেকে গঞ্জের সমস্ত লোক উঠলো বাসে। আমরা নিষেধ করলাম, আর অনেক ভয় দেখালাম। আমার চাকরি চলে যাবে বললাম। লোকগুলো আমাদের কোনো কথায় কান দিল না, তারা ভেতরে গাদাগাদি করে বসলো। গাড়ির ছাদে, পেছনে, বাম্পারে- এই অবস্থাতে গাড়ি ছেড়ে দিতে হলো কারণ বাজারের সরু গলিটা দিয়ে পিলপিল করে আরো অজস্র লোক আসছে। মানুষের গন্ধে আবার কেমন খেপে উঠলাম আমি এবং এমন রোখ চাপলো যে, স্টিয়ারিংয়ের ওপর আমার হাত কাঁপতে লাগলো। আর কাঁধের যন্ত্রণা হতে শুরু করলে। বাঁক ঘুরে দুটো অশ্বত্থ গাছ পার হলাম এবং জপজপ শব্দ হলো। পার হওয়ার সময় এবং তারপর ছ্যাঁত ছ্যাঁত আওয়াজ করে দুটো লরি পাশ কাটিয়ে গেলো এবং রাস্তাটা চুপচাপ গাছের ছায়ায় ঠাণ্ডা হয়ে উঠলো। তক্ষুনি দূরের ট্রাকটা দেখলাম আমি। পিছনের চারটি চাকা আর ছাই ছাই রঙটা সেটা ... নিশ্চয় ধিকিয়ে ধিকিয়ে চলছিল। আমি মুহূর্তে ওটার কাছে চলে এলাম আর হাতল ধরে ঝুলতে থাকা কন্ডাক্টর ফটু হেঁকে উঠল- সাইড, সাইড, এই ট্রাক। আমি দেখলাম লালচে মরচে ধরা লোহার বোঝা নিয়ে যাচ্ছে ট্রাকটা ঝনঝন করে। মোটা মোটা লম্বা রডগুলো পিছনের কংক্রিটের রাস্তায় ঘষতে ঘষতে চলেছে আর আগুনের ফুলকি ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। দিনের আলোর চেয়ে সাদা দেখাচ্ছে ফুলকিগুলো। ডানদিকে বল্লমের মতো উঁচিয়ে আছে একটা রড ট্রাকের বাইরে।
যখন ওটা স্পিড কমিয়ে দিলো আর বিচ্ছিরি আওয়াজ করতে করতে নড়বড়ে বুড়োর মতো বাঁদিকে সরে ফাঁকা রাস্তায় নামলো, আমি পার হয়ে যাওয়ার জন্য দারুণ তেজে আমার গাড়ি চালিয়ে দিলাম। গিয়ার বদলানের সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ কাঁপুনি দিয়ে গর্জে লাফিয়ে উঠে আমার বাস ট্রাক পার হয়ে গেল।
আমার ঠিক মনে পড়ে না- তবে মনে হয় ঠিক এই সময় আমি চিৎকারটা শুনতে পেয়েছিলাম। শব্দটা ঠিক যেন তলোয়ারের মতো আমার বুকের বাঁদিকে ঢুকে বেরিয়ে গেল পিঠ দিয়ে।
গাড়ি থামিয়ে ডান হাতের দরজা খুলে নেমে আমি বাসের পিছন দিক দিয়ে ঘুরে দরজার কাছে গেলাম। অনেক লোক দেখলাম আমি, সবাই নেমে পড়লো বাস থেকে আর শোরগোল চিৎকার শুনলাম আর দুপাশের গাঁ থেকে মানুষ, মানুষ, লাখ লাখ মানুষ আসছে দেখলাম। এই সমস্ত মানুষের মধ্যে বাসের দরজার ঠিক নিচে গোল জায়গায় ফটু শুয়ে আছে। যে আমার সঙ্গে শুয়েছে, যার গলা জড়িয়ে আমি শুয়েছি, যার সবকিছু আমি চিনি, যাকে আমি কথায় কথায় পিটুনি দিতাম আর খানিক আগে যে মার খেয়ে ন্যাংটো হয়ে গিয়েছিল সে আমার কি আমি জানি না। সে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তখনো ট্রাক থেকে বেরিয়ে আসা লালচে মরচে পড়া লোহার রডটা তার বুকের নিচে নাভি দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে আছে। আশ্চর্য, সেদিকে এক ফোঁটা রক্ত নেই। তার পা একটু একটু নড়ছিল। শুকনো ঠোঁট উল্টিয়ে দিয়েছিল, কালো দাঁত বেরিয়ে এসেছিল আর চোখ খুলে আকাশের দিকে চেয়েছিল। মাটিতে, গর্তে তাজা রক্ত তাড়াতাড়ি জমে যাচ্ছিল আর সেই জমাট রক্তে বামুনদের পৈতের মতো দুটো রসকসহীন শুকনো, একেবারে দড়ির মতো পাকানো নাড়ি পড়ে থাকতে দেখলাম।