দূষণের দিকগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বায়ুদূষণ কেবল আমাদের দেশের মাথাব্যথার কারণ না বরং ভারত, পাকিস্তানের বিভিন্ন শহর এবং এরকম জনাকীর্ণ শহরের বড় সমস্যা। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের 'ব্রিদিং হেভি: নিউ ইভিডেন্ট অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যে জানা যায়, দেশের প্রতি বছর উচ্চ মাত্রার বায়ুদূষণের কারণে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে মানুষের শ্বাসযন্ত্র, যার প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, কাশিসহ নানা জটিলতা তৈরি হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণে বছরে জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৩.৯ থেকে ৪.৪ শতাংশ। ঢাকায় বায়ুদূষণের অবস্থা হচ্ছে এয়ার কোয়ালিটি নির্দেশিকা থেকে গড়ে ১৫০ শতাংশ বেশি, যা প্রতিদিন প্রায় ১.৭ শতাংশ ধূমপানের সমতুল্য। মাত্রার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনত্ব বৃহত্তর ঢাকার ইটভাটার কাছে পাওয়া যায়, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১৩৬ গুণ বেশি। ইতিমধ্যেই বায়ুদূষণ কমানোর বিষয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই বিশুদ্ধ বাতাস নেয়ার জন্য গাছপালা উপহার দিয়েছেন। প্রতিদিন বিনামূল্যে সেই বাতাস আমরা ফুসফুসে ভরছি। আর আমরা সেগুলো কেটে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছি। আমাদের দেশের অবস্থা এখনও সে পর্যায়ে যায়নি। কারণ আমরা এখনও বিশুদ্ধ বাতাস নিতে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ভিড় করছি না। সেই দিন হয়তো বেশি দূরে নয় যেদিন একটু সময় বিশুদ্ধ বাতাস পেতে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। দখল-দূষণে রাজধানী আজ বিপর্যস্ত। একটির সমাধান করতে গেলে আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। ডবিস্নউএইচও নির্দেশিত মাত্রার তুলনায় পিএমএএসএর সংস্পর্শে এক শতাংশ বৃদ্ধির ফলে একজন ব্যক্তির শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা ১২.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। ভেজা কাশি হওয়ার সম্ভাবনা ১২.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং নিম্ন শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৮.১ শতাংশ বেশি হতে পারে। বায়ুদূষণ মানসিক স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ডবিস্নউএইচও নির্দেশিত মাত্রার উপর পিএম-২ এর সংস্পর্শ এক শতাংশ বাড়লেই হতাশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকামুখী হচ্ছে। এদের অনেকেই আবার সেখানে স্থায়ী বসবাস করার জন্য চেষ্টা করছে। অনেক আগেই ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মেগাসিটি হয়েছে। সেই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এতে আমাদের প্রাণশক্তি গাছপালা কাটা যায় প্রচুর। রাজধানীর ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। আজ সেখানে কংক্রিটের নিষ্প্রাণ আস্তরণ। মুক্ত বাতাস নেওয়ার মতো জায়গার অভাব সেখানে প্রকট। গাছ কেটে ফেলার পর তা আর লাগানো হয় না। ফলে শহরটা একসময় কেবল কংক্রিটের জঞ্জাল হয়ে পড়ে থাকে। যেখানে গাছপালা নেই সেখানে কীট-পতঙ্গ পাখি নেই, ফলে সেখানে প্রাণ নেই। শহরের পরিণতি হয় ক্রমশ নিষ্প্রাণ। এই নিষ্প্রাণ শহর হওয়ার পরিণতি থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কংক্রিটের জঞ্জাল সরিয়ে প্রচুর সবুজ বনায়ন করতে হবে। আজ দিলিস্ন যে সমস্যায় ভুগছে তা আমাদের জন্যও অপেক্ষা করছে। প্রতিদিন ঢাকায় বসবাসরত মানুষ যে বাতাস দিয়ে ফুসফুস পূর্ণ করছে তাতে নানা ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। মিসরের কথাই ভাবুন। বাংলাদেশে একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি ধরনকে ভিত্তি করে বস্তুকণা (পিএম ১০ ও পিএম ২ দশমিক ৫), এনও ২, সিও, এসও ২, এবং ওজন (৩৩)। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়েছে, ঢাকার বায়ু দূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো, ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটে ধুলো। প্রকৃতি রক্ষা ব্যতীত যে আমাদের অস্তিত্ব থাকে না এই সহজ সত্যটি আমরা প্রথমে বুঝতে পারলেও বুঝতে চাইনি। আজ যখন বুঝতে পেরেছি তখন হয়তো অনেকটা দূরে সরে এসেছি। যদি এখনই নিজেদের বাঁচাতে চাই তাহলে সবাই মিলে পরিবেশ রক্ষা করতেই হবে। তা রাজধানী হোক আর যে কোনো শহরই হোক। কারণ গ্রামগুলোও আজ আধুনিকতার নামে বিলাসিতার নামে গাছপালা উজাড় হয়ে দালানকোঠায় পূর্ণ হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই অপরিকল্পিত নগরায়ণের কার্যক্রম আজও থামেনি। ইটের ভাঁটা থেকে নির্গত ধোঁয়া প্রতিনিয়তই বাতাসে মিশে বিষাক্ত করে তুলছে। এর আগে ডবিস্নউএইচওর তথ্যে জানা গিয়েছিল, বিশ্বের যেসব দেশের শতভাগ মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বায়ু দূষণের মধ্যে বাস করছে তার একটি বাংলাদেশ। আর বলাই বাহুল্য যে, আমাদের দেশের অন্য শহরের তুলনায় রাজধানীর বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি। ঢাকার বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহের অভ্যন্তরে পৌঁছে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েই বিষাক্ত বাতাস টানতে হচ্ছে এ শহরের মানুষকে। একদিকে ইট কাঠের শহর থেকে গাছের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়া অন্যদিকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া যানবাহনের ধোঁয়া, আশপাশের ইটভাটার ধোঁয়া এসব মারাত্মকভাবে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের জন্ম দিচ্ছে। মিসর, কায়রো থেকে অন্যত্র রাজধানী সরিয়ে বায়ু দূষণ থেকে বাঁচার মধ্যে সমস্যার সমাধান খুঁজছে। একসময় ঢাকার বাতাস যখন মানুষের অনুপযোগী হয়ে উঠবে তখন আমরা কি করব? এতকিছুর চেয়ে বরং সমস্যা সমাধানের দিকেই মনোযোগ দেওয়া ভালো। বাতাসে যে কারণে আজ বিষ ঢুকে গেছে সেসব কারণ রোধ করতে হবে। আর অতি অবশ্যই প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। সে ক্ষেত্রে ঢাকার প্রতিটি ছাঁদ বেছে নেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি ছাদেই যদি পরিকল্পনামাফিক বাগান তৈরি করা যায় তাহলেও কিছুটা সমাধান সম্ভব। রাজধানীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলার জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য কত কিছুই করতে পারছি। তবে প্রকৃতিকে কেন কাছে টানতে পারছি না। নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করছি। প্রবাদে আছে, যে ডালে বসে আছি সেই ডালটিই যদি কেটে ফেলি তাহলে সেই ডালের সাথে আমার মাটিতে অধঃপতিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যে গাছপালা আমাদের বুক ভরে শ্বাস নিতে অক্সিজেন জোগাচ্ছে সেই গাছ কেটে অক্সিজেনের উৎস নষ্ট করলে আমাদের ধ্বংসও নিশ্চিত।
অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট