বাংলাদেশ পাখপাখালির দেশ। নানা রংয়ের নানা আকারের মিষ্টি সুরের পাখি আমাদের দেশে। সকালের ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। পাখির কদর আমরা বুঝি। সারা পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ লাখ প্রজাতির পাখি রয়েছে। এসব পাখির অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্যস্থানে নিরাপদে চলে যায়। নিজের অবস্থান বিপৎসংকুল হওয়ায় তারা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। শুধু এশিয়া আর ইউরোপে আছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি। পাখির সৌন্দর্য পাখির কলতান আমাদের পাখি প্রেমিকদের মুগ্ধ করে। শীতকাল শুরু হতেই মূলত আমাদের দেশে নানা বিদেশি পাখির ভিড় বাড়তে থাকে। দেশি পাখির পাশাপাশি তখন বিদেশ থেকে আসা এসব পাখি আমাদের হৃদয় কেড়ে নেয়। আমরা সমাদরে বরণ করে নেই এসব পাখিকে। সারা বাংলাদেশের মানুষ এখন জানে এ সময় বিদেশ থেকে রংবেরংয়ের পাখি এ দেশে এসে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এসব পাখিকে আমরা অতিথি পাখি বলি। এসব পাখিকে ঘিরে পাখি মেলাও অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এদের অতিথি পাখি বলি। সত্যি কথা বলতে বিদেশি পাখি হলেও প্রতি বছর আসা যাওয়ায় এরা আর অতিথি নেই। নামে অথিতি হলেও এরা আমদের দেশেরই অংশ হয়ে গেছে। এসব পাখির উদ্দেশেই যেন পুরো একটি বছর অপেক্ষা করে থাকে পাখি প্রেমীরা। এসব পাখি অতিথি হয়ে এলেও মনে হয় যেন নিজেদের দেশের সৌন্দর্যের একটা অংশ। অন্য দেশ থেকে আসা এসব পাখিকে ইংরেজিতে মাইগ্রেটেড বার্ড বলা হয়। যার পরিভাষা করলে সহজে পরিযায়ী পাখি বলা হয়। দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে আসার কারণে এদের পরিযায়ী পাখি বলা হয়। পাখি পরিযান বলতে নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির প্রতি বছর বা কয়েক বছর পর পর কোনো নির্দিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে কম করে দুটি স্থানের মধ্যে আসা-যাওয়া বোঝায়। যেসব প্রজাতির পাখি এসব পরিযানে অংশ নেয় তাদের পরিযায়ী পাখি বলে। এসব পাখি প্রায় প্রতি বছর কোনো এক দেশ বা একাধিক দেশ বা অঞ্চল থেকে বিশ্বে অন্য কোনো অঞ্চলে চলে যায় কোনো একটি বিশেষ ঋতুতে। মূলত খাদ্যের সহজলভ্যতা, বংশবৃদ্ধি ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থেই তারা এই পরিযানে অংশ নেয়। বাঙালি অতিথিপরায়ণ জাঁতি হিসেবে সুপরিচিত। সে পাখিই হোক আর প্রাণি হোক আর মানুষই হোক। সেই আদিকাল থেকেই অতিথি আপ্যায়নে বাঙালির প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাই শীতকাল শুরু হতেই যেসব পাখি ভিনদেশে থেকে আসতে শুরু করে তাদের নিয়ে উচ্ছল আনন্দে মেতে উঠি আমরা। জাহাঙ্গীর নগর ছাড়াও মোটামুটি দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব পাখি ভিড় করে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসব পাখি আমাদের দেশে আসে। মানে আশ্রয় নেয়। কারণ এ সময়ে সাইবেরিয়াসহ কয়েকটি শীতপ্রধান দেশের শীতের মাত্রা এতটা তীব্র থাকে যে, তা এই পক্ষীকুল সহ্য করতে পারে না। পাখি প্রকৃতির এক অনবদ্য অংশ। সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষায় পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তারা এ দেশে এসে নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করে। শীতপ্রধান দেশের তীব্র শীত দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবারের অভাব দেখা দেয়। সেই সঙ্গে থাকে মারাত্মক তুষারপাত। তাই শীতে উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু অংশে প্রবল তুষারপাত থাকে। এই তীব্র তুষারপাতে এসব পাখি তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে এবং বাংলাদশের মতো অপেক্ষাকৃত কম শীতের দেশে উপস্থিত হয়। শীতকালে বাংলাদেশে আসা পাখিদের মধ্যে অনেক রকম পাখির নাম পাওয়া যায়। স্বচ্ছ পানির বালি হাঁস, খয়রা, চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস পাখি, বড় সারস পাখি, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন পাখি, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্ত প্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া) ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য। এছাড়াও নানা রং আর কণ্ঠ বৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগী, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি পাখির নাম বিভিন্ন তথ্য থেকে পাওয়া যায়। এসব পাখি নান রংয়ের ও আকারের। দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হওয়ায় প্রতি বছর বহু দর্শনার্থীও পাখি দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ায়। পাখির সৌন্দর্য দেখার মানুষের যেমন আমাদের এই দেশে অভাব নেই তেমনি পাখিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণকারী মানুষেরও অভাব নেই। পেশাদার পাখি শিকারীদের সঙ্গে এ সময় যোগ হয় শৌখিন পাখি শিকারীরা। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী অতিথি পাখি ধরা ও বিক্রি করা দন্ডণীয় অপরাধ হলেও আইনের তোয়াক্কা না করে এসব পাখি ধরার কাজ চালিয়ে যায় শিকারীরা। পাখি শিকার করে তা বিক্রি করেই এ সময় অনেক শিকারীর সংসার চলে যায়। যার প্রভাব পরে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে। তাছাড়া পাখি অবাধে ধরার ফলে এসব অতিথি পাখি এখন আগের মতো এ দেশে আসে না। কারণ যে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তারা এখানে আসে সেই জীবনই এখানে থাকে বিপন্ন। তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে অতিথি পাখির উপস্থিতি কমেছে। পাখি প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অতিথি পাখির অবদান অনেক। পাখি হলো প্রকৃতির কীটনাশক। পাখির সংখ্যা কমে গেলে কীটপতঙ্গ বৃদ্ধি পাবে। যা পরিবেশের জন্য হুমকীস্বরুপ। এসব অতিথি পাখিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। গত বছর তো অতিথি পাখি দিয়ে ভোজসভা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে ছবি পোস্ট করেছিল তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন সমাজের কিছু মানুষ। পাখি যারা শিকার করে তারা কেউ ভোজন রসিক আবার কেউ জীবিকা অর্জনের জন্য পাখি শিকার করে। কিন্তু যারা সেসব পাখি কিনে রসনা তৃপ্তি করে তারা বেশির ভাগই কিন্তু আমাদের পরিচিত শিক্ষিত ধনীক শ্রেণি। নিজেদের স্বার্থেই অতিথি পাখি শিকার রোধ করতে হবে। শিকারীরা যাতে পাখি শিকার থেকে বিরত থাকে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। আমরা যদি না কিনি তাহলে এসব অসাধু শিকারীরাও ধীরে ধীরে উৎসাহ হারাবে। সবক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ সম্পূর্ণ সফলতা আনতে পারে না। সচেতনতাও দরকার হয়। যদি পাখি শিকারীদের এটা বোঝান যায় যে, পাখি শিকার করা অন্যায়ের সঙ্গে নিজেদের জন্য ক্ষতিকর তাহলে এ প্রবণতা কমে আসার কথা। এর বিকল্প হিসেবে যদি তাদের এ সময় কোনো বিকল্প অর্থের উৎসের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে হয়তো এই প্রবণতা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
(অলোক আচার্য : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট)