যশোরের যশ খেঁজুরের রস" এ ঐতিহ্যকে ধারন করে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এক জমজমাট খেঁজুর গুড়ের মেলা। ১৬ ও ১৭ জানুয়ারী উপজেলা পরিষদের বৈশাখী মঞ্চে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার সকালে উপজেলা চত্বরে ফিতা কেটে এই মেলার উদ্বোধন করেন উপজেলা চেয়ারম্যান ড. এম মোস্তানিছুর রহমান ও নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম সবুজ, রেজিস্ট্রি কর্মকর্তা মোস্তাক হোসেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইসতিয়াক আহমেদ, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমরেণ বিশ্বাস, জেলা পরিষদ সদস্য দেওয়ান তৌহিদুর রহমান, পৌর মেয়র নূর উদ্দীন আল মামুন হিমেল, প্রেসক্লাব চৌগাছার সভাপতি আবু জাফর সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান রিন্টুসহ প্রায় দুইশো গাছি ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
যশোরের খেঁজুর রস ও গুড়ের ঐতিহ্য শতশত বছরের পুরাতন। যশোর জেলা ধরেই খেঁজুরের রস গুড় উৎপাদিত হলেও রস গুড় উৎপাদনে চৌগাছার রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট। তৎকালিন বৃটিশ ভারতে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজ ব্ল্যাক সাহেব পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ধোবা নামক স্থানে চিনির কল প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু ক্ষতির মুখে কোম্পানি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ঐ সময়ই কলকাতার গ্লাডস্টোন উইলি অ্যান্ড কোং যশোরের চৌগাছায় এসে চিনির কল স্থাপন করেন। একই সময় ১৮৬১ সালে নিউহাউজ সাহেব ভৈরব ও কপোতাক্ষ নদের সঙ্গমস্থল চৌগাছার তাহেরপুরে একটি চিনির কল স্থাপন করেন। পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলে শতশত চিনির কল প্রতিষ্ঠিত হয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোস্পানী ইউরোপে চিনি রপ্তানী শুরু করে।
কালের বিবর্তনে যশোর জেলাসহ চৌগাছার খেঁজুর গুড়ের ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। খেঁজুর গুড়ের সেই পুরোনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে এবং দেশিয় ও আর্ন্তজাতিক বাজারে গুড়ের চাহিদা বাড়াতে চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা খেঁজুর গুড়ের এক ব্যাতিক্রমী মেলার আয়োজন করেন। মেলায় বিপুল সংখ্যক গাছিরা তাদের উৎপাদিত নির্ভেজাল গুড় বিক্রি করনে আনেন। অনেক গাছিই মেলায় গুড় বিক্রি হয় কি হয় না এ সন্দেহের দোলাচালে পড়ে অল্প পরিমানে গুড় মেলায় নিয়ে আসেন। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে গাছিদের সব গুড় বিক্রি হয়ে যায়। মেলায় রস ও গুড়ের তৈরী পিঠা পায়েস দর্শনাথীদের দারুনভাবে আকর্ষণ করে।
মেলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল রস জ্বালানোর পাত্র তাপাল থেকে খেঁজুর গাছের পাতা দিয়ে গরম গরম গুড় খাওয়া। এ গুড় খেতে গিয়ে আগত দর্শনাথীরা যেন নস্টালোজিয়ায় ডুবে যান। গুড় খেতে খেতে অনেকে স্বগোক্তি করেন সেই শৈশবে আর কৈশরের দিনগুলিতে জালই (মাটির তৈরী পাত্র) আর তাপাল (টিনের তৈরী পাত্র) থেকে খেঁজুর পাতা দিয়ে গরম গরম গুড় খেয়েছি আজ আজ খেলাম। অনেকে গুড় খেতে খেতে নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানার প্রশংসা করেন।
গুড়ের মেলার যে নয়নাভিরাম দৃশ্য সবার নজর কাড়ে সেটা ছিল ঐতিহ্যপ্রেমীদের জমপেশ আড্ডা। এই ঐতিহ্যপ্রেমীরা তাদের সকল কাজ ফেলে রেখে মেলার মাঠে দাড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করেন। দুপুর গড়িয়ে বেলা যখন গোধুলীর আভা ছড়াচ্ছিল তখনও চলছে তাদের স্মৃতির পাতার রস-গুড়ের গল্প। এদিকে দর্শনার্থীদের কাছে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে সংবাদকর্মিরা। মেলায় কথা হয় চৌগাছা প্রেসক্লাবের সভাপতি অধ্যক্ষ আবু জাফর,চৌগাছা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল আহমেদ, সাংবাদিক বাবুল আক্তার,আসাদুজ্জামান মুক্তর সাথে তারা সবাই বলেন ব্যাতিক্রমী এ মেলায় এসে খুব ভাল লাগছে। প্রতিবার এ ধরনের মেলার আয়োজন করা হলে ভাল লাগবে।
চৌগাছা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক, তজবীজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জয়নুর রহমান ও সিংহঝুলি ইউন্নি পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ মল্লিক একসাথে গল্প করছিলেন তারা বললেন মেলার আয়োজনে আমরা এতটা অভিভূত যা মুখে প্রকাশ করা অসম্ভব।
মেলায় আগত সিংহঝুলি গ্রামের টনিরাজ, তুষার, সাগর খান,শিমুল, নাকিব খান,বাবুল আক্তার তার সবাই এসেছে মেলায় ঘুরতে তারা সবাই বলেন মেলা দেখতে এসেছিলাম, খুব ভাল লেগেছে। চৌগাছা শহরের চা বিক্রেতা ইলিয়াস হোসেন, ইন্টারনেট লাইনের লাইনম্যান আকিনুর রহমান,লাল্টু মিয়া, ড্রাইভার এখলাস উদ্দিন তারা বলেন, এ ধরনের মেলা আগে কখনও দেখিনি তাই দেখতে আসলাম খুব ভাল লেগেছে।
মেলায় প্রায় ২’শ গাছিরা তাদের উৎপাদিত গুড় নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করেন। মেলায় অংশগ্রহণকারী গাছি শাহীনুর রহমান জানান, এখন আর আগের মত খেঁজুর গাছ নেই। কোন রকম বাপদাদার এই পেশা আমরা ধরে রেখেছি। তিনি বলেন, খেঁজুর গাছ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। গাছিদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করলে এই পেশা ধরে রাখা সম্ভব।
ভাদড়া গ্রামের গাছি আমির হোসেন, পাতিবিলার আনোয়ার মোল্লা, লস্কারপুরের মগরেব আলী, পাতিবিলার দাউদ হোসেন, মাধবপুরের আজিজুর রহমান, সাদিপুরের ইয়াকুব আলীসহ গাছিরা জানান, খেঁজুর গাছ নিধন বন্ধ করলে গুড় উৎপাদন বাড়বে। এ ছাড়া প্রতিবছর অন্যান্য গাছের সাথে খেঁজুর গাছ রোপন করার জন্য সরকারী সহায়তা করা প্রয়োজন।
মেলার শেষ দিনে সমাপনি অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে মেলার সমাপ্তি ঘোষণা কা হয়। সমাপনি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা। প্রধান অতিধি ছিলেন যশোর জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার উপণ্ডপরিচালক হুসাইন শওকত, অধ্যাপক মিজানুর রহমান মধু,উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তানিছুর রহমান, চৌগাছা পৌরসভার মেয়র নুর উদ্দিন আল মামুন হিমেল, চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সবুজ, জেলা পরিষদ সদস্য দেওয়ান তৌহিদুর রহমান,চৌগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। মেলায় দশ হাজার টাকার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন রামভদ্রপুর গ্রামের ইসমত আলি, সাত হাজার টাকার দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করেন হয়াতপুর গ্রামের আবদুল কাজী,পাঁচ হাজার টাকার তৃতীয় পুরস্কার লাভ করেন মাধবপুর গ্রামের হাসান আলি। এ ছাড়া উপজেলার ১১ ইউনিয়ন থেকে ৩৩ জন গাছিকে বিশেষ পুরস্কার প্রদান করা হয়।