ছোটবেলা থেকেই লক্ষণ দাস শারীরিক কসরত দেখিয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। যৌবণে তিনি ছিলেন একজন কুস্তিগির। একসময় জাদু দেখাতেন। নানাগুণে গুণান্বিত মানুষটি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘লক্ষণ দাস সার্কাস’। পরে সেটিই রয়েল পাকিস্তান সার্কাস নামে পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার পর এ দলের নাম হয় ‘দি রয়েল বেঙ্গল লক্ষণ দাস সার্কাস’। বর্তমানে রয়েল বেঙ্গল না থাকায় ‘দি লক্ষণ দাস সার্কাস’ নামে যার নামকরণ করা হয়েছে। মেধা, পরিশ্রম ও দক্ষতার অনবদ্য মিশেলে সার্কাস দলটির সুনাম ছড়িয়েছিল সারাদেশে।
একইসাথে বরিশালের গৌরনদীকে সারাদেশের মানুষ আলাদা করে চিনতো দি লক্ষণ দাস সার্কাসের কারণে। সার্কাস দলটি একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণে পাক সেনাদের নির্মম বুলেটে প্রাণ দিতে হয়েছে সার্কাসের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষণ দাসকে। ওইসময় ঘাতকের বুলেট থেকে রেহাই পায়নি লক্ষণ দাসের প্রিয় পোষা হাতি বাতাসিসহ সার্কাসের নিরীহ প্রাণীগুলো।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে লক্ষণ দাসের ছেলে অরুণ চন্দ্র দাস, বীরেন চন্দ্র দাস, চূড়ামণি দাস, খোকন চন্দ্র দাস ও নিমাই চন্দ্র দাস সার্কাসটি পুনরুজ্জীবিত করেন। অরুণ নিজেও একজন সার্কাসশিল্পী। গোলাকার বৃত্তে মোটরসাইকেল চালানোয় পারদর্শী। সবার সহযোগিতায় অল্পদিনেই সার্কাস দলটি দেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে কালের বির্বতনে আকাশ সাংস্কৃতির যুগে হারিয়ে যেতে বসেছে একসময়ের লোকজ সাংস্কৃতির জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম সার্কাস শিল্প। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আজও লক্ষণ দাস সার্কাসের নিভু নিভু আলো জ¦ালিয়ে রেখেছেন প্রতিষ্ঠাতার দুই ছেলে। অতিসম্প্রতি সরকারী অর্থায়নে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রের সূত্রে আবারও আলোচনায় এসেছে দি লক্ষণ দাস সার্কাসের অতীত ইতিহাস। এছাড়াও বিগত তিন বছর পর সার্কাস প্রদর্শণের জন্য প্রশাসনের অনুমতি মিলেছে। আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে এক মাসব্যাপী দেশের ঐতিহ্যবাহী দি লক্ষণ দাস সার্কাসের প্রদর্শণ করা হবে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার ২২৮ তম বাৎসরিক সূর্যমণি মেলার মাঠে।
পুরনো স্মৃতি ॥ সু-বিশাল সাতটি বড় নৌকার বহর ছিলো লক্ষণ দাসের। ৮০ থেকে ৯০ জন খেলোয়াড়, কলাকৌশলী ছিলেন ওই দলে। এ ছাড়া হাতি, বাঘ, ভালুকসহ প্রায় ১৫ প্রজাতির প্রশিক্ষিত জীবজন্তু ছিলো নানা খেলা দেখানোর জন্য। বৃহত্তর বরিশালসহ দেশের বিভিন্নস্থানের নদীর তীরবর্তী এলাকায় সার্কাস প্রদর্শন করা হতো। বিভিন্ন মেলায় প্রতিদিন তিন থেকে চারটি শো-হতো।
অস্তিত্ব সংকটে ॥ গৌরনদীর দক্ষিণ পালরদী গ্রামে ৩৫ একর জমিতে লক্ষণ দাসের বাড়ি। বছরে শুধু রমজান মাসে সার্কাসের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে কাটাতেন লক্ষণ দাস। সেই বাড়িটি এখন নীরব। দীর্ঘদিন সার্কাস বন্ধ থাকায় লাখ লাখ টাকার মালামাল নষ্ট হচ্ছে। হাতিসহ বিভিন্ন জীবজন্তু টিকিয়ে রাখতে পথে বসার উপক্রম হয়েছে লক্ষণ দাসের ছেলে অরুণ দাসের। সরকারী নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও রহস্যজনক কারণে কোনো জায়গায় সার্কাস খেলা প্রদর্শনের অনুমতি না মেলার কারণে এরইমধ্যে অনেক খেলোয়াড় দল ছেড়ে পেশা পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে গেছেন। করোনার কারণে যে অচলাবস্থার তৈরি হয়েছিল, তা আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এক মাসব্যাপী সূর্যমণি মেলায় সার্কাস প্রদর্শনের মাধ্যমে কাটিয়ে ওটার চেষ্ঠা করা হচ্ছে। এজন্য চলে যাওয়া শিল্পীদের পূর্ণরায় ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্ঠা করা হচ্ছে।
প্রাণ নিল পাক সেনারা ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারী গৌরনদী কলেজে পাকিস্তানী হানাদারদের সবচেয়ে বড় স্থায়ী ক্যাম্প ছিলো। ক্যাম্পের অদূরেই দক্ষিণ পালরদী গ্রামে লক্ষণ দাসের বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করায় লক্ষণ দাসকে হত্যার ছক কষে স্থানীয় রাজাকাররা। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পাশের আগৈলঝাড়া উপজেলার কোদালধোয়া এলাকায় স্ত্রী লীলা দাস, বড় ছেলে অরুণ দাসসহ পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে লক্ষণ দাস আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সেখানেই লক্ষণ দাসকে হত্যা করে পাক সেনারা। সেদিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার বড় ছেলে অরুণ চন্দ্র দাস।
সেদিন লক্ষণ দাস যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই বাড়ির মালিক সুনীল কুমার সরকার (৮০) বলেন, আমার সামনেই লক্ষণ কাকাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমাকেও খুব মারধর করেছিলো রাজাকাররা। লক্ষণ দাসের বড় ছেলে অরুণ দাস এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সেসব দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, পাক বাহিনীর খবর পেয়ে আমি একটি ছাতিম গাছে উঠে আশ্রয় নিয়েছিলাম। প্রথমে দুটি স্পিডবোটে পাক সেনা ও রাজাকাররা কোদালধোয়া বাজারে এসে দোকানগুলো পুড়িয়ে দেয়। পরে সুনীলদার বাড়িতে গিয়ে বাবাকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন রেহাই পায়নি সার্কাসের নিরীহ প্রাণীগুলোও। বাবার প্রিয় পোষা হাতি বাতাসি শিকল ছিঁড়ে বাবার কাছে আসতে চেয়েছিল। বিষয়টি দেখে বাতাসিকেও পাঁচটি গুলি করে মেরে ফেলে পাক সেনারা। এ ছাড়া স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়ে মাকে ব্যানেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারতে চেয়েছিল। মা মরার ভান করে পানিতে ভেসে থাকে।
ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা ॥ লক্ষণ দাসের জেষ্ঠপুত্র অরুণ ও দ্বিতীয় ছেলে বীরেন চন্দ্র দাস বর্তমানে সার্কাস দলটি পরিচালনা করছেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিজাম উদ্দিনের নগদ ১০০ টাকা আর কয়েকটি হলুদ রঙের তাবু এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মেজর (অব.) শাহ আলম তালুকদারের সহযোগিতা আর মা লীলা দাসের কিছু অলংকার বিক্রির টাকাই ছিল তাদের শেষ সম্বল। পরবর্তীতে সহদর অন্যান্য ভাইদের সহযোগিতায় সার্কাসটি পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমেই অল্পদিনেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অরুণ চন্দ্র দাস বলেন, যতোদিন বেঁচে আছি বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি এই সার্কাস শিল্পটিকে ধরে রাখবো। তিনি আরও বলেন, চেষ্টা করছি আবারও দর্শকদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, গৌরনদীর লক্ষণ দাস সার্কাস আমাদের ঐতিহ্য। এটিকে রক্ষা করার জন্য সম্মিলিতভাবে সবার এগিয়ে আসা উচিত।
প্রামাণ্যচিত্র ॥ সার্কাস দলটির দীর্ঘ পালাবদলের গল্প আর সার্কাস শিল্পীদের টিকে থাকার লড়াইয়ের কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘দি লক্ষণ দাস সার্কাস’। সরকারী অনুদানে নির্মিত সিনেমাটি প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন ঝুমুর আসমা জুঁই। মূলত লক্ষণ দাসের গড়া সার্কাস দলটির বিভিন্ন পালাবদল এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। লক্ষণ দাসের সার্কাস দলের ইতিহাস তুলে ধরে নির্মাতা ঝুমুর আসমা জুঁই বলেন, সার্কাস শিল্পের জনক গৌরনদীর লক্ষণ দাস ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘লক্ষণ দাস সার্কাস’। পরে সেটিই রয়েল পাকিস্তান সার্কাস নামে পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার পর এ দলের নাম হয় ‘দি রয়েল বেঙ্গল লক্ষণ দাস সার্কাস’। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে লক্ষণ দাস মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করায় পাক সেনাদের হাতে নির্মমভাবে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও লক্ষণ দাসের সেই সার্কাস দল নিঃশেষ হয়ে যায়নি। লক্ষণ দাসের ছেলে অরুণ দাস ও বীরেণ দাস সার্কাসের দল বাঁচিয়ে রাখতে এখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।
জুঁই আরও বলেন, সার্কাস দলে সব সময় ৭০ থেকে ৮০ জন লোক কাজ করেন। তাদের পরিবারের জীবিকা এ কাজের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু কালের বির্বতনে আকাশ সাংস্কৃতির যুগে সার্কাস প্রদর্শনীর সংখ্যা দিন দিন কমে আসায় সার্কাসের গুণি শিল্পীরা বেকার হয়ে পরেছেন। এখন সার্কাস করার জন্য সহজে অনুমতি না পাওয়ায় সার্কাসের মতো বড় আয়োজনের খেলা প্রদর্শন করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার ও জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। এসব কিছুই নিয়েই সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে।