মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহুর্তে ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদীর বাটাজোর নামকস্থানে এ্যাম্বুসে থাকা পাক সেনাদের সাথে ৯নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা নিজাম বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। ওই যুদ্ধে আমিসহ ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন আকনের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেছিলাম।
সারারাতের যুদ্ধে পাকসেনারা পরাস্থ হওয়ার পর ভোরে পাকসেনাদের অবস্থান নেয়া জায়গায় গিয়ে দেখতে পাই সাতজন পাকসেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। আমাদের তিন সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হয়েছেন। পরবর্তীতে ওইদিন ভোরে স্থানীয় গভীর জঙ্গলের মধ্যদিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় অস্ত্রবিহীন তিনজন পাক সেনা সুবেদার শরীফ খান বেলুচী, সিপাহী নাসির খান পাঞ্জাব ও সিপাহী ফিরোজ খান বিহারীকে আমি একাই আটক করেছিলাম।
পরবর্তীতে তাদের (আটক পাক সেনাদের) স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, বাটাজোর সিএন্ডবি রোডের সন্নিকট থেকে তিনটি ব্যাটাগান ও কিছু গুলি উদ্ধার করি। এরপর আটককৃত পাকসেনাদের সাব সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিনের কাছে সোর্পদ করেছি। ওইযুদ্ধে আমার সহকর্মী মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন সিকদার গুরুত্বর আহত হয়ে একটি পা হারিয়ে আজো পঙ্গু অবস্থায় বেঁচে আছেন।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের ধানডোবা গ্রামের মৃত মিলন হাওলাদারের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আনসার প্যারেড কমান্ডার এম.এ রব যুদ্ধদিনের কথা জনকন্ঠের কাছে এভাবেই বর্ননা করে আরও বলেন, আনসার বাহিনীর একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে শেষপর্যন্ত আমি নয়টিস্থানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ২২ডিসেম্বর নিজের জীবন বাঁজি রেখে সরকারী গৌরনদী কলেজের পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন আকন ও আমি প্রবেশ করেছি। সেদিন ক্যাম্পে অবস্থানরত ১৪৭ জন পাকসেনাকে আটক করে মিত্র বাহিনীর কাছে সোর্পদ করেছিলাম।
এম.এ রবের বয়স বেড়ে যাওয়ায় নানারোগে আক্রান্ত হলেও আজো তার মনে রয়েছে কঠিন জোর। আনসার বাহিনীর একজন দক্ষ প্যারেড কমান্ডার হিসেবে তিনি এখনও বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে আসছেন। বলেন, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে দেশ মাতৃকার টানে আনসার বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথমে আমি গৌরনদী কলেজ মাঠের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে অংশগ্রহণ করি। পরবর্তীতে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের পি.পা ক্যাম্পে (পলাশীর আমতলা ক্যাম্প) যাই। সেখান থেকে মেজর এম.এ জলিল আমাদের স্বশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বিহার চাকুলিয়া স্টেশন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে একমাস বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, কলাকৌশল গ্রহণের পর ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম.এ জলিল বেগুণদিয়া হেড কোয়ার্টার থেকে অস্ত্রসহ নিজাম উদ্দিনকে সাব সেক্টর কমান্ডার ও আবু তাহেরকে সহকারী কমান্ডার করে ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আমাদের ৬৫ জনের একটি গ্রুপ দেশে পাঠিয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা গ্রুপ সহকারে দেশে ফেরার পথে যশোরের আড়পাড়া এলাকায় পৌঁছলে পাক সেনাদের সাথে প্রথম যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে অনেক পাক সেনা নিহত হয়। একপর্যায়ে পরাস্থ পাক সেনা ও তাদের দোসর এ দেশীয় রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এরপর গৌরনদীর মাহিলাড়া ব্রীজের ওপর পাক বাহিনীর সাথে আমাদের গ্রুপের সম্মুখ যুদ্ধে অনেক পাক সেনা হতাহতের পর ওই এলাকার পাক সেনাদের ব্যাংকার মুক্ত করি। হোসনাবাদ এলাকায় পাকবাহিনীর লঞ্চে হামলা চালিয়ে অসংখ্য পাকসেনাকে হত্যা করে তাদের অস্ত্র উদ্ধার করেছি।
মুক্তিযোদ্ধা এম.এ রব আরও বলেন, টরকী বন্দরের সাবেক ন্যাশনাল ব্যাংকে পাহারত রাজাকার ও পুলিশ ক্যাম্পে আমরা একাধিক হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করে ২১টি রাইফেল ও বিপুল পরিমান গুলি উদ্ধার করেছিলাম। ওই বছরের ১৩ কার্তিক কসবা গো-হাট সংলগ্ন ব্রীজের ওপর ব্যাংকার করে পাহারত পাক সেনাদের সাথে আমাদের গ্রুপের তুমুল যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে আমি যেখানে এ্যাম্বুসে ছিলাম তার মাত্র পাঁচ হাত দূরত্বে থাকা আমাদের গ্রুপ কমান্ডার আবদুস সাত্তার পাক সেনাদের একাধিক বুলেটে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পরবর্তীতে বরিশালের সকল মুক্তিযোদ্ধারা একত্র হয়ে বরিশাল নগরীর ওয়াপদায় স্থায়ী ক্যাম্প করা পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করি। ওইদিন ওয়াপদা ক্যাম্পের পাকসেনারা পরাস্থ হয়ে বরিশাল ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে বিজয় ঘোষণা করা হলেও সে সময়েও গৌরনদী কলেজে স্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থানরত পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করেনি। আমরা (মুক্তিযোদ্ধা)সহ মুজিব বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত বাহিনীর সদস্যরা কলেজের চারিদিক থেকে ঘিরে পাকসেনাদের কলেজের ক্যাম্পে যৌথ আক্রমণ শুরু করি। তখনও যুদ্ধ চলতে থাকে। একপর্যায়ে ওই ক্যাম্পে অবস্থান নেয়া পাকসেনারা ২১ ডিসেম্বর হ্যান্ড মাইকের সাহায্যে আত্মসমর্পনের ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২২ডিসেম্বর নিজের জীবন বাঁজি রেখে সরকারী গৌরনদী কলেজের পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ৯নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন আকন ও আমি প্রবেশ করি। এরপর ক্যাম্পে অবস্থানরত ১৪৭ জন পাকসেনাকে আটক করে মিত্র বাহিনীর কাছে সোর্পদ করেছি।
এম.এ রব বলেন, ২৩ ডিসেম্বর আমরা বরিশালে কর্মরত প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে ২৫ ডিসেম্বর বরিশাল অঞ্চলের সকল মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর সদস্যরা একত্র হই। সেখানে বসে ক্যাপ্টেন সামসুদ্দিন খান আমাদের প্রত্যেককে ৫০ টাকা করে দিয়ে সবাইকে স্ব-স্ব থানার ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্পে যোগদানের জন্য পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্পে যোগদান করে আমি ১৯৩জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত বি-কোম্পানীর টু-আইসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। ১০ জানুয়ারি স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তার ভাষন শুনে আমি ঘরে ফিরে এসেছি।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ রব বলেন, দেশ স্বাধীন করেছি কিছু পাওয়ার জন্য নয়। তারপরেও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আমাদের যা দিয়েছেন তার ঋণ কোনদিনও শোধ হবার নয়। এরপরেও আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে যদি স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করতে পারতাম তাহলে মরেও শান্তি পেতাম।