তিন বছর পর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা-২০২৩। এবারের বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য-পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। আগামীকাল বুধবার বিকাল তিনটায় সশরীরে উপস্থিত হয়ে বইমেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার বিকালে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. কেএম মুজাহিদুল ইসলাম। এ সময় তিনি বইমেলা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। বিকাল ৩টায় বইমেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। শুভেচ্ছা বক্তব্য দিবেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নুরুল হুদা। সভাপতিত্ব করবেন একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অমর একুশে বইমেলা ২০২৩-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলা একাডেমি প্রকাশিত সাতটি নতুন বইয়ের গ্রন্থ-উন্মোচন করবেন এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২২ প্রদান করবেন। যে সাত গ্রন্থ-উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী সেগুলো হলো- শেখ মুজিবুর রহমান রচনাবলি-১, কারাগারের রোজনামচা পাঠ বিশ্লেষণ, অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ বিশ্লেষণ, আমার দেখা নয়াচীন পাঠ বিশ্লেষণ, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ রচিত আমার জীবন নীতি, আমার রাজনীতি, জেলা পর্যায়ে আয়োজিত মেলা নিয়ে গবেষণাধর্মী প্রকাশনা-১। বইমেলার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে কেএম মুজাহিদুল ইসলাম জানান, এবার বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায়। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১১২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৬৫টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৮৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৩৬টি ইউনিট অর্থাৎ মোট ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে ১০১টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলায় ৩৮টি প্যাভিলিয়ন থাকবে। এদিকে এবার বইমেলার আঙ্গিকগত ও বিন্যাসে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে গতবারের মূল প্রবেশপথ এবার একটু সরিয়ে বাংলা একাডেমির মূল প্রবেশপথের উল্টো দিকে অর্থাৎ মন্দির-গেটটি মূল প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। গতবারের প্রবেশপথটি বাহির-পথ হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। এ ছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউশন অংশে আরও ৩টি প্রবেশ ও বাহির-পথ থাকবে। গতবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন সংলগ্ন অংশে ১৮২টি স্টল এবং ১১টি প্যাভিলিয়ন ছিল। পাঠক, দর্শক এবং প্রকাশকদের সম্মিলিত আহ্বান ছিল এবারের মেলায় যেন তাদের দৃশ্যমান অংশে সন্নিবেশ করা হয়। ২০২৩-এর বইমেলার বিন্যাস সবার জন্যই মনঃপুত এবং বাস্তবসম্মত হয়েছে বলে মনে করছেন আয়োজক কমিটি। তবে গতবারের ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের স্থানটিকেও এবারের মেলার একটি অংশ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। সেখানে নামাজের স্থান, ওয়াশরুমসহ অন্যান্য পরিষেবা অব্যাহত থাকবে। খাবারের স্টলগুলোকে এবার এমনভাবে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে যেন এলোমেলোভাবে খাবারের স্টল বইমেলায় আগত পাঠকের মনোযোগ বিঘ্নিত না করে। শিশুচত্বরটির পরিধি কম হওয়ায় এবার এই চত্বরটি মন্দির-গেটে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে। যেন শিশুরা অবাধে বিচরণ করতে পারে এবং তাদের কাক্সিক্ষত বই সহজে সংগ্রহ করতে পারে। প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত 'শিশুপ্রহর' থাকবে। অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি এবং সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকছে। এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গ্রন্থ উন্মোচন অংশের কাছাকাছি। সেখানে ১৫৩টিসহ ৫টি উন্মুক্ত স্থানে লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বইমেলায় বাংলা একাডেমি এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ২৫% কমিশনে বই বিক্রি করবে। প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলা একাডেমির ৩টি প্যাভিলিয়ন এবং শিশুকিশোর উপযোগী প্রকাশনার বিপণনের জন্য ১টি স্টল থাকবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে। অমর একুশে বইমেলা ২০২৩-এ প্রচার কার্যক্রমের জন্য একাডেমিতে বর্ধমান ভবনের পশ্চিম বেদিতে ব্যবস্থা থাকবে। মেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে একটি মিডিয়া সেন্টার থাকবে। বর্তমান সরকারের 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' ধারণার অংশ হিসেবে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে জমাকৃত নতুন বইয়ের প্রচ্ছদ, তথ্য এবং বইমেলার মানচিত্র পর্যায়ক্রমে প্রদর্শিত হবে। মেলায় ওয়াইফাই সুবিধা থাকবে। মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। বইমেলার প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। মেলায় এলাকাজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বইমেলা পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত থাকবে। মেলাপ্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। মেলার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মিত ধূলা নিবারণের জন্য পানি ছিটানো এবং প্রতিদিন মশা নিধনের ব্যবস্থা থাকবে। অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশককে 'চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার' এবং ২০২২ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা বই প্রকাশের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানকে 'মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। এ ছাড়া ২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য ১টি প্রতিষ্ঠানকে "রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার” এবং এ বছরের মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক সাজসজ্জায় শ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে 'কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার' প্রদান করা হবে। এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ও পুনর্মুদ্রিত ১৩৬টি বই। বইমেলা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে আটটার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবেন না। ছুটির দিন বইমেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ২১ শে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টা এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বইমেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি নুরুল হুদা বলেন, প্রতি বছর আমরা নতুন ধরনের প্রয়োজন অনুভব করি। এখন পর্যন্ত আমরা মেলার যতটুকু বিন্যাস করেছি তা ভালো হয়েছে, এক জায়গায় দাঁড়ালে সুন্দর করে সকল স্টলগুলো দেখা যায়। সবার যে জায়গাটা নিয়ে অভিযোগ ছিল-ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট সংলগ্ন জায়গায় আমরা খাবারের স্টলগুলো নিয়ে গেছি। এবারই আমরা সবগুলো খাবারের দোকান এক জায়গায় করতে পেরেছি। শুরুতেই বইমেলা-২০২৩ পরিচালনা কমিটির সদস্য ও বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের উপণ্ডকর্মকর্তা সমির কুমার সরকার শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন মেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ক্রসওয়াক কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মারুফ, বিকাশ লিমিটেডের সিএমও মীর শওকত আলী। প্রশ্নোত্তর পর্বে আদর্শকে স্টল না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল হুদা বলেন, আদর্শ আমাদের কাছে শর্ত মেনে স্টল বরাদ্দের আবেদন করেছিল। এবং সেখানে তারা আমাদের বলেছিল বইমেলার যে নীতি তা অগণতান্ত্রিক। আমরা তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে কার্যনির্বাহী কমিটিকে জানিয়েছি তাদের আবেদনের বিষয়ে। কমিটি সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে জানিয়েছে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।