৫০ বছর পুরনো বিদ্যালয়টিতে দুবছর আগেও শিক্ষার্থীতে পূর্ণ ছিল। শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য ছিলেন ৭ জন শিক্ষক। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চে বসার প্রতিযোগিতা করত শিক্ষার্থীরা। মাঠে চলত খেলা-ধুলায়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত শিশুদের পড়াশোনা,ডাক চিৎকার, দৌড়াদৌড়িতে বিদ্যালয়টি মুখর থাকত। এখন সব কিছুই প্রাণহীন। এবছর একজন শিক্ষার্থীও এ বিদ্যালয়ে নেই।
এমনটাই বলছিলেন মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ৫০ নং চরবলাকি (নতুনচর) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহরিন সুলতানা। তিনি ২০১০ সাল থেকে এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।
বিদ্যালয়ের এমন অবস্থা হওয়ার বিষয়ে স্থানীদের সঙ্গে কথা বলে জানাযায়,৫০ নং চরবলাকি (নতুনচর) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি হোসেন্দি ইউনিয়নের লগুরচর এলাকার প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত। এ এলাকায় প্রায় দুই হাজার মানুষের বসতিছিল। এ গ্রামটির সব ছোট বাচ্চারা এ বিদ্যালয়টিতেই পড়াশোনা করত। গত বছর একটি কোম্পানি জায়গা কেনা শুরু করে। স্থানীয় লোকজন তাদের বাড়ি-ঘর, জমিজমা বিক্রি করে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। যার ফলে বিদ্যালয়টি থাকলেও সেটি শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে যায়।
বিদ্যালয় সুত্রে জানাযায়, ১৯৭৩ সালে ৩৩ শতাংশ জমির উপর বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম দিকে একটি টিনের ঘরের মধ্যমে পাঠদান শুরু হয়। ১৯৯৩ সালে তিন কক্ষবিশিষ্টি একটি একতলা পাকা ভবন হয়। শিক্ষার্থীদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ২০১০-১১ অর্থ বছরে দুই কক্ষের আরো একটি ভবন করা হয়। তখন বিদ্যালয়ে ৭ জন শিক্ষক ছিলেন। ২০১৭-১৯ সালে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত গড়ে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। ২০১৯ সালের পর শিক্ষার্থী কমতে থাকে,২০২০ সালে ছিল ১০৭ জন,২০২১ সালে ১০২ জন। সে সময় শিক্ষার্থী কম থাকায় শিক্ষক ছিলেন ৪ জন। ২০২২ সালের শুরুতে একটি কেম্পানি তাদের স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে। সে বছর মাত্র ৩৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এপ্রিল মাস পর্যন্ত কোন রকম শ্রেণির পাঠদান করছিলেন শিক্ষকরা। তবে এপ্রিলের পর থেকে কোন শিক্ষার্থী আর ক্লাসে আসেনি।হয়নি বার্ষিক পরিক্ষা। এবছর একজন শিক্ষার্থীও ভর্তি হয়নি বিদ্যালয়টিতে। তবে দুজন শিক্ষক প্রতিদিন বিদ্যালয়ে আসেন।
বুধবার বেলা এগারটার দিকে বিদ্যালয়টিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দুজন নারী শিক্ষক বিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। বিদ্যালয়টির পাঁচটি শ্রেণিকক্ষে ঝুলছে তালা। এ সময় শিক্ষকেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের দুজনের মধ্যে একজন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং অন্যজন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
সহকারি শিক্ষক সুরাইয়া আক্তার বলেন,প্রতিদিন এভাবেই মাঠে দাঁড়িয়ে থেকে,অফিস কক্ষে বসে থেকে তাদের সময় কাটছে। পাঁচ বছর আগে তিনি এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে শিক্ষক জীবন শুরু করেছিলেন। তার ভাষ্য,স্কুলে আসতাম, বাচ্চাদের সাথে মেতে থাকতাম। বাচ্চাদের মত বাচ্চা হয়ে, বাচ্চাদের পড়াতাম। স্কুলের আঙিনায় বাগান করেছিলাম। শিক্ষক,শিক্ষার্থী,অভিভাকদের আনাগোনায় সব সময় কোলাহল লেগে থাকতো। এ বছর শিক্ষার্থীর অভাবে সব কিছু শেষ হয়ে গেলো।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহরিন সুলতানা বলেন,চতুর দিকে কেম্পানীর সীমানা প্রাচীর স্থাপনা। এক পাশে শুধু আমাদের বিদ্যালয়টি। মানুষজন এ গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলেগেছে। এ বছর একজন শিক্ষার্থীও বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। চার জনের মধ্যে দুজন শিক্ষক অন্য বিদ্যালয়ে প্রেষণে আছেন। আমরা দুজন শিক্ষক প্রতিদিন বিদ্যালয়ে এসে বসে থাকি। এভাবে আর কতদিন। আমরা চাই দ্রুত বিদ্যালয়ের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হওক।
বিদ্যালয়টির সভাপতি ছিলেন হোসেন্দি ইউপি চেয়ারম্যান মো.আক্তার হোসেন। গত বছর তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারাযান। এরপর এ ইউপিতে উপনির্বাচন হয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী না থাকায় পরিচালনা কমিটি আর গঠন করা হয়নি।
বিদ্যালয়টির বিষয়ে গজারিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মমতাজ বেগম প্রথম আলোকে জানান, এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করছে।বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী শূন্য বিষয়টি এবং বিদ্যালয়টি সবশেষ অবস্থা নিয়ে কিছুদিন আগেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে।বিদ্যালয় থাকবে নাকি এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যে ধরনের সিদ্ধান্ত দেবে সেই মোতাবেক কাজ করা হবে।
লগুরচর এলাকার মানুষজন জায়গা-জমি বিক্রির পর গত বছর থেকে উপজেলার নিবিরচর, হোসেন্দি, নাইজ্জর, ফুলদি এলাকায় বসতি করেছেন। অনেকেই আবার নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও বন্দর এলাকায় চলেগেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে নিবির চর এলাকায় গিয়ে কথা হয় বিল্লাল হোসেন নামে এক ব্যাক্তির সঙ্গে। বিল্লাল হোসেন বলেন,বাপ-দাদার আমলের ভিটা কেউ ছাড়তে চায়না। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপাচাপিতে বসত ভিটা বিক্রি করে চলে এসেছি। আমার একটা মেয়ে চরবলাকি বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো। তাকে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়েছি।
ওই বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আতিকা ইসলাম বলে, গত বছর দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। সবাই বাড়ি বিক্রি করে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। সহপাঠিরা কেউ বিদ্যালয়ে আসতো না। এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমিও বিদ্যালয়ে ক্লাস করেছি। বাবা কোম্পানীর কাছে জায়গা বিক্র করে দেয়। কোম্পানি চতুর দিকে তাদের বাউন্ডারি দিয়ে ফেলে। এর পরে আমরাও গ্রাম ছেড়ে নিবিরচরে চলে এসেছি।