ছোটবেলায় অন্যের বাড়িতে গরু খামারে কাজ করতেন। সেই সুবাদে মাঠে গরু নিয়ে গেলে বিভিন্ন ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান বের করতেন তিনি। সেই ধান দিয়ে মুড়ি-মোয়া খাওয়ার লোভে ইঁদুর ধরতেন আনোয়ার হোসেন। পরে সেটিই হয়ে উঠে তার জীবন-জীবিকার মাধ্যম। জয়পুরহাটের কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর উপজেলাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার কৃষকরা তাকে ডেকে নিয়ে যান ইঁদুর ধরার জন্য। এতে কৃষকরা খুশি হয়ে ৩শ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত বকশিশ দিয়ে থাকেন আনোয়ার’কে। ইঁদুর ধরার জন্য কোনো মন্ত্র জানেন না। তিনি শুধু কৌশল অবলম্বন করেন। এ কৌশলে ইঁদুর তার কাছ থেকে দূরে পালাতে পারত না। দীর্ঘদিন যাবৎ ইঁদুর ধরতে ধরতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন আনোয়ার হোসেন (৫০)।
প্রায় তিরিশ বছর ধরে ইঁদুর ধরতে ধরতে এখন তার আসল নাম মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন থেকে ইঁদুর আনোয়ার নামেই বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় কৃষকেরা তাকে ‘ইঁদুর আনোয়ার’ হিসেবেই চেনেন। তিনি কৃষকের ফসলের ক্ষেত ও বাড়ি থেকে ইঁদুর ধরে মৃত ইঁদুরের লেজ সংগ্রহ করেন। এতে প্রতি বছর কৃষি অফিসে ৮ থেকে ৯ হাজার ইঁদুরের লেজ জমা দিয়ে টাকা ও উপহার সামগ্রী পান আনোয়ার হোসেন (৫০)। আনোয়ার হোসেনের বাড়ি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের নুরনগর গ্রামে। তার বাবার নাম আবদুল জব্বার। তার সংসারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। এ কাজ করে তিনি পরিবারে অনেক স্বচ্ছলতা এনেছেন।
সাম্প্রতিক কালে মি.আনোয়ার হোসেন-এর সঙ্গে বলে জানা গেছে, ১৯৯৩ সাল থেকে ইঁদুর ধরে আসছেন আনোয়ার হোসেন। ইতোমধ্যে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানে তিনি বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন। ২০০৪ সালে ২৪ হাজার ৩শ ৫১টি ইঁদুর মারার জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে ঢাকার খামারবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে পুরস্কার হিসেবে ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন পেয়েছিলেন। এই ৩০ বছরে তার কাছে ইঁদুর ধরার কৌশল শিখেছেন প্রায় ৮১ জন কৃষক। তাছাড়া ইঁদুর ধরার ফাঁদ বা ইঁদুর মারার ওষুধও বিক্রি করেন তিনি। এ কাজ করে তিনি পরিবারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। বসতভিটা করেছেন। কিনেছেন কিছু আবাদি জমিও।
মি.আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার বাবা মানুষের বাড়িতে আমাকে কাজে রেখেছিলেন। সেখানে থেকে আমি গরু চরাতাম। গরু চরাতে গিয়ে দেখতাম ধান দিলে মুড়ির মোয়া দিত। তাই মাঠ থেকে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান বের করেছি। সেই ধান দিয়ে মুড়ির মোয়া খেয়েছি আর গরু চরিয়েছি। আমি কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর উপজেলাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় প্রায় ৩০ বছর ধরে ইঁদুর ধরে জীবিকা নির্বাহ করছি। এ কাজে প্রয়োগ করি নিজের আবিষ্কৃত নানা কৌশল। ফসলের মাঠ আর বসত বাড়ির ইঁদুর নিধনের জন্য আমাকে কেউ দেন চাল, কেউ দেন গম, কেউ দেন ডাল, কেউবা দেন অন্যান্য খাদ্য দ্রব্য, আবার কেউ কেউ দেন টাকাও। ইঁদুর ধরার ব্যস্ততার কারণে আমি মাসে দুই থেকে তিন বার বাড়িতে যাই। ইঁদুর ধরার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে ঘুড়ে বেড়াই। তাছাড়া এলাকার বিভিন্ন হাট-বাজারে ইঁদুর ধরার ফাঁদসহ ইঁদুর মারার ওষুধ বিক্রি করি আবার একই সঙ্গে ইঁদুর ধরা কাজও করছি। এভাবে প্রতিদিন ৫শ থেকে ৬শ টাকা আয় হয়।
এলাকার কৃষকরা আমাকে ডেকে নিয়ে যান ইঁদুর ধরার জন্য। আমি কৃষকের ফসলের ক্ষেত ও বাড়ি থেকে ইঁদুর ধরে মৃত ইঁদুরের লেজ সংগ্রহ করি। এতে কৃষকরা খুশি হয়ে ৩শ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বকশিশ দিয়ে থাকেন বলে মি. আনোয়ার বলেন।
তিনি আরও বলেন, ইঁদুর ধরার জন্য কোনো মন্ত্র পড়ি না। শুধু কৌশল অবলম্বন করি। দীর্ঘদিন ইঁদুর ধরতে ধরতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এতোদিনে প্রায় তিন লাখ ইঁদুর মেরেছি। ইঁদুর আমার কাছ থেকে দূরে পালাতে পারে না। আমাকে কৃষকেরা এখন ইঁদুর আনোয়ার হিসেবেই ডাকেন। এতে আমি অখুশি কিংবা বিরক্ত হই না বরং খুশি হই। এ নামে ডেকে লোকজনও খুশি হন। আমি প্রতি বছর উপজেলার কৃষি অফিসে ৮ থেকে ৯ হাজার ইঁদুর মেরে মরা লেজ জমা দেই। এতে কৃষি অফিস আমাকে টাকাসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিয়ে থাকে। জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানে অংশগ্রহণ করে কৃষি অধিদপ্তর থেকে কয়েক বার জাতীয় পুরস্কার ও সনদ পেয়েছি। ইঁদুরগুলো ফসলের ও বাড়ির আসবাবপত্রের অনেক ক্ষতি করে। গ্রামের কৃষি পরিবারগুলো ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ থাকে। আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা অসংখ্য কৃষি পরিবারকে এই যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করেছে। আমি এতে অনেক খুশি।
কালাই উপজেলার বহুতী গ্রামের আরেক কৃষক রিফাদ হোসেন বলেন, আমার বাড়িতে ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। পরে আনোয়ারকে বাড়িতে ডেকে আনলে তিনি ইঁদুরগুলো সব ধরে মেরে ফেলেন। এতে আমার পরিবারের অনেক উপকার হয়েছে।
উপজেলার নুরনগর গ্রামের কৃষক রমজান আলী বলেন, আলুর ফসল রক্ষায় বাজার থেকে অনেক ধরনের ওষুধ কিনেও যখন ইঁদুর নিধন করতে পারিনি, ঠিক তখন আনোয়ারের শরণাপন্ন হই। পরে ধীরে ধীরে আমার ফসলের ক্ষেত ইঁদুর মুক্ত পেয়েছি।
এ বিষয়ে কালাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ অরুণ চন্দ্র রায় বলেন, ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষা করাটা বেশ দুস্কর। ইঁদুর ফসলের জন্য খুব ক্ষতিকর প্রাণী। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণে ফসল ইঁদুরের পেটে চলে যায়। ইঁদুর নিধনের জন্য বিষ প্রয়োগসহ নানান কৌশলেও কাজ হচ্ছে না। প্রতি বছরই ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু অতি সহজ পদ্ধতিতেই এই অসাধ্য সাধন করে যাচ্ছেন আনোয়ার। কালাই উপজেলাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় ইঁদুর নিধনে সেরা অবস্থানে রয়েছেন আনোয়ার হোসেন। তিনি ইঁদুর নিধন করে কৃষি পরিবারের অনেক উপকারে আসছেন।