আমদানি কমায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতিতে পড়েছে হিলি ও ভোমরা স্থলবন্দর। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আড়াই লাখ টনেরও বেশি পণ্য আমদানি কমেছে। আর গত আড়াই বছরে ৮২৬ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ঘাটতি পড়েছে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর। এলসি জটিলতা, ডলার সংকট, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতিসহ নানা সমস্যার কারণে এই ঘাটতি তৈরি হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং স্থলবন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ডলার সঙ্কটে ব্যাংকগুলো সব পণ্য আমদানির জন্য এলসি দিচ্ছে না। ফলে অনেকাংশেই কমে গেছে স্থলবন্দরগুলো দিয়ে শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি। এ ছাড়া শুল্কায়ন জটিলতার কারণেও আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৯২৫ টন পণ্য আমদানি হয়েছিল। আর চলতি অর্থবছরের একই সময় আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৩ হাজার ৬৪১ টন। ওই হিসেবে আমদানি ২ লাখ ৫৬ হাজার ২৮৪ টন কমেছে। ৬ মাসে ৫ হাজার ৮১৫টি ট্রাকে ২ লাখ ৯৫ হাজার টন পাথর, ৪১৭টি ট্রাকে ১১ হাজার ৪৮৪ টন জিরা, ২ হাজার ২২২টি ট্রাকে ৫০ হাজার ৬১২ টন গমের ভুসি, ১ হাজার ২৯টি ট্রাকে ৪০ হাজার ১৫ টন গম, ২ হাজার ৯১১টি ট্রাকে ৮৪ হাজার ৫৩৮ টন পেঁয়াজ, ১ হাজার ২০৩টি ট্রাকে ৪৮ হাজার ৯১৪ টন ভুট্টা, ২১৩টি ট্রাকে ৪ হাজার ৬৩৮ টন বাদাম এবং ২ হাজার ৪১৬টি ট্রাকে ১ লাখ ৪ হাজার ২৩৬ টন চাল আমদানি হয়েছে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ভোমরা স্থলবন্দরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা ছিল ১ হাজার ১২১ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে জুলাই-জুন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয় ৭৬০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ওই হিসেবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬০ কোটি ২২ লাখ টাকা। তাছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ভোমরা বন্দর দিয়ে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৯৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৪১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ওই হিসেবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে পারছে না। অনেক পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ রয়েছে। ব্যাংকগুলো সব পণ্য আমদানির জন্য এলসি দিচ্ছে না। বিশেষ করে শুল্কযুক্ত পণ্যগুলো বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে না বললেই চলে। হিলি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানীকৃত পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাথর থেকে শুল্ক আহরণ হয়। পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে পাথরের চাহিদার বেশির ভাগই ওই বন্দর দিয়ে আমদানি হয়। কিন্তু ডলারের সংকটের কারণে কোনো ব্যাংক এলসি দেয়ায় পাথরসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি অনেক কমে গেছে। বর্তমানে শুধু খাদ্যদ্রব্য আমদানির জন্য এলসি দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া হিলি স্থলবন্দর দিয়ে অন্য পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। শুল্কায়ন জটিলতার কারণে আমদানিকারকদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিশেষ করে মোটরসাইকেল যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে বেনাপোল বন্দরে যে মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়, হিলি স্থলবন্দরে তার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়। বন্দর দিয়ে আগে বিপুল পরিমাণ মোটরসাইকেল যন্ত্রাংশ আমদানি হলেও বর্তমানে তা কমেছে। ব্যবসায়ীরা এখন বেশির ভাগই বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি করছে। তাছাড়া ফল আমদানির ক্ষেত্রে গাড়ির চাকা অনুযায়ী শুল্কায়ন করা হয়। যে কারণে হিলি বন্দর দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ফল আমদানি বন্ধ রয়েছে। ওসব জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি বাড়বে। সূত্র আরো জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত ভোমরা স্থলবন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৫৩১ কোটি ০১ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৬ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৭৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ওই হিসেবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৫৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২ হাজার ৬০৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। তার বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ হাজার ৭৮০ কোটি ৮ লাখ টাকা। ওই হিসেবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮২৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। নিম্নমুখী আমদানিই হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম কারণ। ব্যবসায়ীরা তাদের চাহিদামতো পণ্য আমদানি করতে পারছে না। পূর্ণাঙ্গ বন্দর হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ব্যবসায়ীদের সব ধরনের পণ্য আমদানি করতে দেয়া হয় না। তবে চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে আমদানি পরিস্থিতি মোটামুটি ভালো ছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কায় পণ্যের দাম কমলেও আমদানি ব্যয় বেশি। আগে বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ১৮০-২২০ ট্রাক পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হতো। এখন তা কমে ১০০ ট্রাকে দাঁড়িয়েছে। এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ভোমরা শুল্ক স্টেশনের দায়িত্বরত কাস্টমসের ডেপুটি সহকারী কমিশনার নেয়ামুল হাসান জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরের পর থেকে নানা সংকটে বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দেয়। ফলে রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে শুরু করে। তাছাড়া সম্প্রতি ব্যাংকে এলসি জটিলতা ও ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে হিলি স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশনের উপকমিশনার বায়জিদ হোসেন জানান, বন্দর দিয়ে আমদানি কমে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে বন্দর দিয়ে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৯২৫ টন পণ্য আমদানি হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের একই সময় তা ৭ লাখ ৩ হাজার ৬৪১ টনে নেমেছে। ৬ মাসে ২৯৪ কোটি ৬ লাখ টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আহরণ হয়েছে ২১৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।