বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে বিপুল বিনিয়োগেও বাড়ছে না ট্রেনের গতি। বরং কমে আসছে। মূলত জরাজীর্ণ রেললাইনের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৩ হাজার ৯৩.৩৮ কিলোমিটার রেলপথের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ রেললাইন চরম ঝুঁকিপূর্ণ। আর শোচনীয় অবস্থা আছে রেললাইনের ব্রিজগুলোও। ফলে কোনোভাবেই ট্রেনের গতি বাড়ছে না। তাছাড়া ৭৩ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৫২ শতাংশ কোচ মেয়াদোত্তীর্ণ এবং ১ হাজার ৩৫০টি অবৈধ লেভেল ক্রসিংও গতিরোধে অনেকটা দায়ী। বিগত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সময় মেনে ট্রেন চলার হার ছিল গড়ে ৮৭ শতাংশ। বর্তমানে ৬০-এর নিচে। অথচ রেলে মোটা বিনিয়োগের মূল শর্তই ছিল ট্রেনের গতি বাড়বে, শিডিউল অনুযায়ী ট্রেন চলবে। শূন্যের কোঠায় আসবে লাইনচ্যুত ও দুর্ঘটনা। কিন্তু শুধুমাত্র জরাজীর্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ লাইনের কারণেই ৯০ শতাংশ লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রেলের উন্নয়নে গত এক যুগে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আরো পৌনে ২ লাখ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প চলমান আছে। তার মধ্যে লাইন সংস্কারে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা বরাদ্দ থাকলেও সেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বরং সারা দেশের ৩ হাজার ৯৩.৩৮ কিলোমিটার রেলপথের ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ রেললাইন এখনো চরম ঝুঁকিপূর্ণ। রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য গত এক যুগে যে খরচ করা হয়েছে তার মধ্যে সারা দেশের রেলপথ সংস্কারে ৯০০ কোটি টাকারও কম বরাদ্দ ছিল। গত অর্থবছরে ওই খাতে (রেলপথ সংস্কার) বরাদ্দ ছিল ১১০ কোটি টাকা আর চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ ১২৩ কোটি টাকা। সূত্র জানায়, নতুন রেলপথ তৈরি, রেলের ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও বেতনভাতা বাবদই রেল পেছনে খরচ হাওয়া ৯৫ হাজার কোটি টাকার ৮৫ শতাংশ অর্থ খরচ হয়েছে। আর বছরের পর বছর উপেক্ষিত থাকছে জরাজীর্ণ রেলপথ। চলমান রেলপথের প্রায় ৭৫ শতাংশই বড় ধরনের মেরামত প্রয়োজন। চলমান লাইন, ব্রিজ যথাযথ সংস্কারে দরকার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে রেলে ন্যূনতম ১৫টি অত্যাধুনিক ট্যাম্পিং মেশিনের প্রয়োজন। যার মাধ্যমে রেললাইনের যাবতীয় ত্রুটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা হয়। বর্তমানে সারা দেশে মাত্র ৪টি রয়েছে ওই মেশিন। তার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই দুটি অকেজো। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে হেঁটে হেঁটে রেললাইন দেখাশোনা করা হয় এবং তাও নিয়মিত করা হয় না। সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ৩৬৬টি যাত্রীবাহী এবং ৫০টি মালবাহী ট্রেন চলাচল করছে। ১৩ বছরে অত্যাধুনিক ৫৫০টি যাত্রীবাহী কোচ, ৭৮টি ইঞ্জিন, ২০ সেট ডেমু, ৫১৬টি ওয়াগন এবং ৩০টি বগি ব্রেক ভ্যান, ২টি রিলিফ ক্রেন কেনা হয়েছে। ১৪২টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। বর্ধিত করা হয়েছে বিদ্যমান ৪৪টি ট্রেনের রুট। মোট ৩ হাজার ৯৩.৩৮ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ১৬৭৯.৮৩ কিলোমিটার মিটারগেজ, ব্রডগেজ ৮৭৯.৮৫ কিলোমিটার এবং ৫৩৩.৭০ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেলপথ আছে। নতুন কিংবা পুরোনো লাইনে কোনোমতেই ৮ ইঞ্চি পুরুর কম পাথর থাকা যাবে না। তবে গত ১৩ বছরে যেসব অত্যাধুনিক রেল ইঞ্জিন ও কোচ আমদানি করা হয়েছে সেগুলো ১৩০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন। গতি বেশি নিয়ে চলতে হলে লাইনে ১৫ থেকে ১৮ ইঞ্চি পাথর থাকতে হয়। আর উচ্চগাতির ট্রেনের জন্য প্রয়োজন ২০ থেকে ২২ ইঞ্চি পাথর। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে রেলপথের প্রায় ৯০ শতাংশ স্থানেই ৬ ইঞ্চি পুরু পাথর নেই। কোনো কোনো স্থানে পাথর একেবারেই নেই। এদিকে এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. কামরুল আহসান জানান, রেলে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণ-বাস্তবায়নও হচ্ছে। কিন্তু রেলপথ সংস্কার খুবই জরুরি। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অবৈধ লেভেল ক্রসিং, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ নিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। রেলওয়ে অত্যাধুনিক ইঞ্জিন-কোচ কিনলেও তা দিয়ে নতুন লাইনে সর্বোচ্চ গতি নিয়ে ট্রেন চালানো সম্ভব। কিন্তু পুরোনো লাইনগুলোয় নির্ধারিত গতি নিয়ে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।