সত্য, প্রেম, পবিত্রতার মহান আদর্শে বরিশালের বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত তার বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে ১৮৮৯ সালে “বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ প্রষ্ঠিতা করেন। প্রাচীণ ঐতিহ্যবাহী এবং বাংলার অক্সফোর্ড খ্যাত সেই কলেজটি এখন ভাষা আন্দোলনে বরিশালের একমাত্র সূতিকাগার।
সূত্রমতে, ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রাম শুরু হওয়ার পূর্বে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালে এসে বিএম কলেজে সভা করে ছাত্রদের সংগঠিত করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের এ সভাই ছিলো বরিশালের প্রথম সভা। শেখ মুজিবুর রহমান বরিশালের সভা শেষে ঢাকায় যাওয়ার পর ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবীতে প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট করে সেক্রেটারিয়েট ঘেরাও করা হয়। ওইদিন শেখ মুজিবুর রহমানসহ বরিশালের গৌরনদী থানার কাজী গোলাম মাহবুব ও সরদার ফজলুল করিম গ্রেপ্তার হন। ওইসময় বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম বরিশালে ভাষা আন্দোলনের দাবিতে মিছিলে নামেন সাধারণ মানুষ। প্রথমবারের ওই আন্দোলনে পুলিশ হামলা চালায়। নির্যাতনের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের ওই মিছিল। এরপর ১৪ মার্চ পালিত হয় ধর্মঘট।
প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ছিলো বিএম কলেজের স্বর্ণযুগ। সে সময় বরিশালে পৃথক কোনো ছাত্র সংগঠন ছিলোনা। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলো শিক্ষার্থীরা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকেই মূলত ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের সূচনা ঘটে ঐতিহ্যবাহী বিএম কলেজে। এখান থেকে বরিশাল অঞ্চলে স্বাধীকার আন্দোলনের উৎপত্তি ঘটে। পরবর্তীতে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে ধীরে ধীরে সংঘটিত হতে থাকে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। শুধু তাই নয়; একুশে ফেব্রুয়ারির সাংস্কৃতিক চেতনাকে মনেপ্রাণে ধারণ করেছিলেন বরিশালের অনেক কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পী।
সূত্রমতে, ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। বাংলার জনগণ নাজিম উদ্দিনের উক্তির তীব্র সমালোচনা করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। আওয়ামী মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে ওইসময় গঠণ করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ২৮ সদস্য বিশিষ্ট সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয় বরিশালের গৌরনদী থানার লাখেরাজ কসবা গ্রামের কৃতী সন্তান কাজী গোলাম মাহবুবকে। এ ছাড়া ২৮ জন সদস্যর মধ্যে পাঁচজন ছিলেন বরিশালের সন্তান। তারা হলেন- আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব (আওয়ামী লীগ), মুজিবুল হক ভিপি-সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, দৌলতখানের শামসুল আলম ভিপি-ফজলুল হক হল, পিরোজপুরের শামসুল হক চৌধুরী-ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ ও আখতার উদ্দীন আহমদ। ফলে খুব সহজেই ভাষা আন্দোলনের উত্তাপ বরিশালে ছড়িয়ে পরে।
ওই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি আবদুল মালেক খানকে সভাপতি এবং যুবলীগের সম্পাদক আবুল হাশেমকে আহ্বায়ক করে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট বরিশালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠণ করা হয়। বরিশাল যুবলীগের সভাপতি আলী আশরাফ ছিলেন সংগ্রাম পরিষদের অবিসংবাদিত নেতা। সেসময় বরিশালে ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএম কলেজের ছাত্ররা ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। ২১ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর বরিশালের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শহরে হরতাল পালিত হয়। ওইদিন ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদ বরিশালে পৌঁছলে একজন পুলিশ সদস্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে তা জানান এবং ওই রাতেই সার্কিট হাউজের কাছে অবস্থিত বরিশাল মুসলিম ইনস্টিটিউটে সংগ্রাম পরিষদের সভা বসে এবং পরে কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়।
সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৫ থেকে ৮১ জনে উন্নীত করা হয়। বরিশাল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে অন্তর্ভুক্ত যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন, আবদুল মালেক খান (সভাপতি, তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের জেলা সভাপতি), আবুল হাশেম (সম্পাদক, যুবলীগ), অ্যাডভোকেট আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আলী আশরাফ, আবদুল আজিজ তালুকদার, প্রাণকুমার সেন, জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর, হাজী আবদুল লতিফ খান প্রমুখ।
ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালে হরতাল ও মিছিল হয়। অন্যান্য জায়গার মতো বরিশালেও আন্দোলনকে সংগঠিত করার পেছনে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীসহ বরিশালের ছাত্রসমাজ ছিলো চালিকাশক্তি। বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথক ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠণ করেছিলেন। ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি এবং বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট গৌরনদীর সন্তান সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া। বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের আহবানে ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে পরেছিলেন বরিশাল শহরে।
অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে ভোর থেকে ছাত্র-জনতার স্রােত নামে। গ্রাম থেকে আসা জনতা ছাড়াও শহরের শত শত নারীরা হামিদ উদ্দিনের (আওয়ামী লীগ নেত্রী) নেতৃত্বে প্রথম শোভাযাত্রা বের করেন। বরিশালের অন্য নারী ভাষা সৈনিক হলেন-হোসনে আরা নিরু, মঞ্জুশ্রী, মাহেনুর বেগম, রানী ভট্টাচার্য প্রমুখ। এছাড়াও অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী খান বাহাদুর হাশেম আলী, অ্যাডভোকেট শামসের আলী নগ্নপদে ওই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় বরিশাল শহরের একে স্কুল মাঠে শহীদ ছাত্রদের গায়েবী জানাজা শেষে শোকর্যালি বের করে শহর প্রদক্ষিণ করে অশ্বিনী কুমার টাউন হল চত্বরে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই শোকসভায় সভাপতিত্ব করেছেন ভাষা সৈনিক একেএম আজহার উদ্দিন। ২৪ ফেব্রুয়ারি শহরের সদর রোডের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতের অন্ধকারে সরকারি নির্দেশে পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে।
ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বরিশালের ছাত্রসমাজ তথা মুক্তিকামী মানুষের ভূমিকা ছিলো সবসময় জোরাল। ষাটের দশকের নানা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান এবং ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে এ অঞ্চলের ছাত্র নেতারা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরেও বরিশাল অঞ্চলের নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আবেগ অনুভূতি আজো মনেপ্রাণে হৃদয়ে ধারণ করা হচ্ছে।
বরিশালের গৌরব শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন এবং শহীদ মিনার নির্মাণ ও বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ করার প্রস্তাব অনুমোদন করেন। বরিশালের সন্তান সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে এসব গৃহীত প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ’৫২’র রক্তাক্ত পথ ধরে ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।
বরিশালের ভাষা সৈনিকদের পরিচিতি ॥ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব ১৯২৭ সালে গৌরনদী থানার লাখেরাজ কসবা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কৃষক নেতা মরহুম আবদুল মাজেদ কাজী। অ্যাডভোকেট শামসুল আলম ভোলার দৌলতখান থানার হাজীপুর গ্রামে ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৌলভী গোলাম রহমান পন্ডিত। শামসুল আলম ছিলেন বিএম কলেজের ছাত্র। মোহাম্মদ মুজিবুল হক ১৯৩০ সালে ঝালকাঠির গাভা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ মোবারেক উদ্দীন সরদার। মুজিবুল হকও বিএম কলেজের ছাত্র ছিলেন। মুহাম্মদ শামসুল হক চৌধুরী পিরোজপুরের দুর্গাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। আখতার উদ্দীন আহমেদ ঝালকাঠী থানার নবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার অগ্রভাগে ছিলেন বরিশালের সন্তান স্পীকার আবদুল ওহাব খানের মেয়ে সামছুন্নাহার এবং নলছিটির নন্দিকাঠী গ্রামের খান সাহেব বদরুদ্দিন আহমেদের মেয়ে সুফিয়া খান। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন, শামসুল আলম, সৈয়দ আশরাফ, আবদুল লতিফ, খন্দকার আলমগীর প্রমুখ।