ভাষা আন্দোলনের পটভূমি বেশ দীর্ঘ। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ। শুধু তাই নয় পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার অধিকারকে বুকের রক্ত দিয়ে আপন করে নেয়ার রেকর্ড শুধুমাত্র বাঙালির। রফিক, সালাম, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদের রক্তস্নাত এই অর্জন বিশ্বে বাঙালিকে অমর করে রাখাসহ ‘অমর একুশ’-এর সূত্র ধরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত করা শ্রেষ্ঠ সন্তানের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যতদিন লাল সবুজের পতাকা খচিত এই বাংলাদেশ থাকবে, বঙ্গবন্ধু থাকবে ততদিন পৃথিবীর বুকে বাংলা ভাষা আপন মহিমায় চির জাগরূক হয়ে। বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও, বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে; ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। বাঙালি জাতির প্রকৃত ভিত্তিসূত্র বাংলা ভাষা। ঐতিহাসিকভাবে বাংলা যেমন শোষিত শ্রেণির ভাষা, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনও আজীবন শোষিত শ্রেণির মুক্তির জন্য লড়াই করা। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এই আন্দোলন বাংলার মাটিতে এমন এক সংগ্রামের বীজ বপন করে দেয়, যা পরবর্তীকালের আন্দোলন-সংগ্রামগুলোতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় কাজ করে! স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে সংবিধান প্রণীত হয়, তা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তিনি পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের আহ্বানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এ ধর্মঘটে শেখ মুজিবুর রহমান সাহসী ভূমিকাও রেখেছিলেন। এছাড়াও মিছিলের সব ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এই হরতালে তরুণ শেখ মুজিব নেতৃত্ব দেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত হয়েছিল আট দফা চুক্তি। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে প্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক শেখ মুজিবসহ অন্য ভাষা সৈনিকরা কারামুক্ত হন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ২১ মার্চ মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর নেতৃত্বে উপস্থিত ছাত্র-জনতা তীব্র প্রতিবাদ করেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন-সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আবদুস সালাম, অলিউল্লাহ প্রমুখ। বহু নেতা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। প্রতিবাদে সারা বাংলায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের জেলা ও মহকুমা প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। সেদিন সব আন্দোলন, মিছিল এবং নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সেদিন বজ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খোলা রহিয়াছে-হয় তাঁহারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন’ ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে মাতৃভাষার জন্য সেদিন যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, সে চেতনায় ধাবিত হয়ে বাংলার মানুষ আজ অর্জন করছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলা ভাষায় প্রদত্ত তার ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর ঐতিহাসিক দলিলের স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রে পালিত হচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন করেছিলেন, বাংলা ভাষার চেতনাকে বুকে ধারণ করেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তার মতো এমন মহানায়ক আর কেউ হবেনা তাই তো বঙ্গবন্ধু, বাংলা ভাষা ও বাঙালির আন্দোলন অবিচ্ছেদ্য। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছরে এসেও আমরা এখনও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারিনি। এতে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এটি-ই হতে পারে ভাষাশহীদ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়। পৃথিবীর সর্বত্র সব মাতৃভাষা আপন গতিতে বিস্তার লাভ করুক এই আমাদের প্রত্যাশা।