পানি সঙ্কটে বিপর্যস্ত দেশের কৃষিখাত। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় সর্বত্রই পানির উৎসগুলো প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। দেশের নদণ্ডনদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা, নালা সব শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। একই সাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও স্থানভেদে কোথাও ৮ থেকে ১০ ফুট, কোথাও ৩০ থেকে ৪০ ফুট নিচের দিকে নেমে গেছে। ন্যূনতম স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে উঠেছে পরিবেশ-প্রকৃতি। আর কৃষি-খামার, জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় সর্বত্র বোরো আবাদ, মৌসুমী ফল ও ফসল, ক্ষেত-খামার, মাছের চাষ থেকে শুরু করে সমগ্র কৃষি খাত চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে বোরো আবাদ। বোরো ধানের বীজতলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আর চাষাবাদে পানির অভাব পূরণ করতে গিয়ে সেচের বাড়তি খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে কৃষক। কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের কোথাও গত জানুয়ারি মাসে সামান্য বৃষ্টিপাতও হয়নি। আর নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি টানা ৩ মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টির শতকরা ৮৮ ভাগই ঝরেনি। অর্থাৎ গত ৩ মাসেরও বেশি সময় অনাবৃষ্টিতে কেটেছে। চলতি ফেব্রুয়ারি ও আগামী মার্চ মাসেও স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত অর্থাৎ খরা-অনাবৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে বলে আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। এ অবস্থায় কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ মাস খরাদশা চলতে পারে। আর দীর্ঘসময় বৃষ্টি না হওয়ায় পুরো সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে বোরো আবাদসহ অন্যান্য ফল-ফসল আবাদ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভূ-উপরিভাগের পানির সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় এখনই অত্যধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। ফলে আরো নিচে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। তাতে ভয়াবহ মাত্রায় হ্রাস পাঁচ্ছে ভূ-উপরিভাগ ও ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ। মৌসুমের এ সময়ের স্বাভাবিক পরিমাণ বৃষ্টিও না হওয়ায় মাটির উপরের উৎসগুলোতে এবং মাটির নিচে পানি রিচার্জ হচ্ছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় আরো বাড়ছে খরার ঝুঁকি। ফলে তীব্র সঙ্কটের মুখে পড়ছে কৃষি খাত। সূত্র জানায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রকট হচ্ছে পানি সঙ্কট। ইতোমধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে চলে গেছে। রাজশাহীসহ উত্তরের ৬ জেলা খরার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের ২২ জেলা খরার ঝুঁকিতে থাকলেও খুবই উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁ। বরেন্দ্র অঞ্চলে মওসুমভিত্তিক জলবায়ুর এলোমেলো আচরণে শীত হচ্ছে স্বল্পকালীন আর খরা হচ্ছে প্রলম্বিত। কমে গেছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। ফলে বৃষ্টিনির্ভর ফসল এখন সেচনির্ভর ফসলে পরিণত হয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তার কথা ভেবে বছরজুড়েই মাটির নিচ থেকে পানি তুলে চাষাবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পাতালের পানি পুনঃভরন হচ্ছে না। ফলে পানির স্তর নামছেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে অনেক স্থানে পানির নাগাল পাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। ওই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ বয়ে আনছে প্রলম্বিত খরা। টানা বৃষ্টিহীনতা, এমনকি শীত মৌসুমেও কাক্সিক্ষত বৃষ্টি না হওয়ায় সবকিছু মিলিয়ে পানির শঙ্কা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘসময় বৃষ্টি না হওয়ার ফলে বোরো আবাদ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি খরার কবলে ঝরে পড়ছে আমের মুকুল। আম বাগানেও এখন সেচ দিতে হচ্ছে। আর খাদ্যনিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বরেন্দ্র অঞ্চলে অধিক পরিমাণে ধান চাষ হচ্ছে। অন্যান্য ফসলও আবাদ হচ্ছে। তাতে ভূগর্ভস্ত পানির উপর চাপ বাড়ছে। সূত্র আরো জানায়, বৃষ্টির অভাবে বগুড়ার করতোয়া, বাঙালি, ইছামতি, নাগর, গাঙ নৈ প্রভৃতি নদণ্ডনদীসহ খাল-বিল সব শুকিয়ে গেছে। ফলে এ মৌসুমের প্রধান ফসল বোরো ধান ও বোরো ধানের বীজতলাসহ অন্যান্য ফসল সম্পূর্ণ সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে। তাতে বেড়ে যাচ্ছে ফসলের উৎপাদন খরচ। বোরো চাষে পর্যাপ্ত সেচের পানি না থাকায় সিলেটের কৃষকদের বিড়ম্বনার শেষ নেই। সিলেটে চলতি মৌসুমে ব্যাপক পরিমাণ অনাবাদি জমি বোরো চাষের আওতায় এসেছে। কিন্তু হাওর অঞ্চলে বিলের মৎস্য আহরণ শেষ হওয়ায় সেগুলো পানি শুকিয়ে তলানিতে। তাই বোরো ধানে পানি সেচ নিয়ে সংগ্রাম চালাচ্ছেন কৃষকরা। তাছাড়া চলতি শুষ্ক মৌসুমে পুকুর, নদী-খালের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় কক্সবাজার জেলায় খাদ্যে উদ্ধৃতের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। জেলার ফসলি জমিতে পানি সরবরাহের অন্যতম খাল-নদী শুকিয়ে গেছে। প্রধান নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ নেই বললেই চলে। প্রধান নদী বাঁকখালী ও মাতামুহুরীর দুই পাড়ে বোরো আর রবিশষ্যের যে উৎপাদন হত তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একইভাবে মানিকগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন খাল বিল পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। ফসলি জমিতেও এর প্রভাব পড়ছে। বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষককে বিকল্প উপায়ে শ্যালোমেশিন দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে। তাতে কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়ায় নেত্রকোণা জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠের ফসলি বোরো জমিও শুকিয়ে যাচ্ছে। চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। আর শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনায় দীর্ঘদিনের একটানা খরার তীব্রতায় ফসলি জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। রোদে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে ধানের চারাসহ অন্যান্য ফসলাদি। ফসলি জমির সেচ কাজ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।