পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল এবং সোনালি আঁশ ও বলা হয়ে থাকে। ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ/পাট পণ্যের বাংলাদেশ’ এ স্লোগানে পাটের সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি বিবেচনায় ২০১৬ সালে প্রতিবছর ৬ মার্চ জাতীয়ভাবে পাট দিবস পালনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরের বছর থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। তাছাড়া বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আবারও সোনালি আঁশের দেশ হিসেবে রূপান্তর করে পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস পালন করা হবে।’ বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনসহ সারাদেশ নানা কর্মসূচি আয়োজনের মাধ্যমেও পাট দিবস দিনটিকে উদযাপন করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। আট থেকে দশ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট বা আঁশ জাতীয় ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাংলাদেশে বছরে উৎপাদিত পাট আঁশের শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ পাট কলগুলোতে ব্যবহৃত হয়, প্রায় ৪৪ ভাগ কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি হয় ও মাত্র ৫ ভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে কাজে লাগে। যদিও পাটের এখন সেই রমরমা অবস্থা নেই, তবে সেসব সমস্যা কাটিয়ে পাট বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত পণ্যের মর্যাদা ফিরে পাঁচ্ছে। পাট মন্ত্রণালয় থেকে যানা যায়, বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাতে বেশি পরিমাণ উর্বর জমি খাদ্য শস্য চাষের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পাটের উর্বর আবাদি জমির পরিমাণ কম এবং ক্রমাগত প্রান্তিক ও অনুর্বর জমিতে পাট আবাদ স্থানান্তরিত হলেও জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর প্রধান কারণ পাট চাষে বিজেআরআই উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি উচ্চফলনশীল জাত এবং উৎপাদন কলাকৌশলের ব্যবহার। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় শতকরা ১২ ভাগ পাট চাষ এবং পাটশিল্প প্রক্রিয়াকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন কাজের সাথে জড়িত। এছাড়াও কাঁচা পাট ও পাট জাত দ্রব্য বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস। পাট ফসল দেশের কর্মসংস্থানে, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিরাট সহায়ক ভূমিকা রাখছে, বিশেষ করে পাটের আঁশ বিক্রির টাকা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে, গ্রামীণ জনপদে সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও পরবর্তী রবি শস্য চাষে আর্থিক মোকাবিলা করার সাহায্য করে এ পাট চাষ। গত বছর ২০২২ সালে পাট ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে অবদানের জন্য ১১ ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, চাষি ও প্রতিষ্ঠানকে পাট পুরস্কার দিয়েছিলের সরকার। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় পাট দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন কৃষিমন্ত্রী মোঃ আবদুর রাজ্জাক। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তখন প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। পাটের সম্ভাবনার সঙ্গে শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে বছরে পাট ও কৃষিপণ্যের রপ্তানি আয় শিগগিরই ১ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘পাটবীজে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চাই। ইতোমধ্যে পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাটের উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। এখন কৃষকদের মধ্যে এটিকে জনপ্রিয় করার কাজ চলছে। আমরা আশা করছি, আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। তখন ভারত থেকে পাটবীজ আর আমদানি করতে হবে না।’ ইদানীং চট, বস্তা, পলিথিন ছাড়াও চোখ ধাঁধানো শোপিস, চেয়ার, দরজা, ফুলদানি, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, স্যুট-প্যান্ট, চাদর, এমনকি ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য যেমন সৌন্দর্যবর্ধক তেমনি শতভাগ পরিবেশবান্ধব এবং দামও সাধ্যের মধ্যে। ফলস্বরূপ, এসবের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বিশ্ববাজারের ক্রেতাদের। ফলে নিঃসন্দেহে এ শিল্প দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তাই দ্রুত বিভিন্ন যুগোপযোগী উদ্যোগের মাধ্যমে পাটের ব্যবহার বহুমুখীকরণ করতে হবে। পাশাপাশি সরকার কেউ দেশে ও বিদেশে পাট পণ্যের ব্যবহার বিস্তৃত করার বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে সরকার পাট সংগ্রহ, সংরক্ষণ- সবকিছুতে আরও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তবে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পাট চাষে কৃষকরা দিন দিন আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই পাটের চাষ বৃদ্ধি করতে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধাসহ কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করতে হবে। এর ফলে তাদের মধ্যে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা বাড়বে। বন্ধ পাটকলগুলো চালু করা, পাটের বহুমুখী ব্যবহার ইত্যাদির ফলে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে, পরিণতিতে পাট চাষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।