জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতি বছরের মতো এবারো ৮ মার্চ পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশেষ এই দিনটি পালন করা শুরু হয়েছিল সমাজে নারীদের গুরুত্ব ও অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই। এটি এমন একটা দিন, যা সূচনাপর্ব থেকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে নারীদের সম্মানের কথা মনে করিয়ে দেয়। লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য এই দিনটি পালিত হয়। শিল্পণ্ডসাহিত্যসহ সব ধরনের ক্ষেত্রে এবং সমাজের সমস্ত কাজে নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতেই এ দিনটি উদযাপন করা হয়ে থাকে। নারী দিবসকে কেন্দ্র করে নানাজনের নানা ভাবনা থাকলেও প্রকৃত অর্থে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে নারীর অর্জন উদযাপন করা হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল লক্ষ্য। এর পাশাপাশি সমাজে নারীর সমতার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে এ লক্ষ্যে সচেতনতা বাড়ানোও এর আরেকটি উদ্দেশ্য। নারী দিবস উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। এমনকি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ উপলক্ষে ৮ মার্চ দুপুর আড়াইটায় এক শোভাযাত্রার আয়োজন করেন। শোভাযাত্রাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশে নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর জাতীয় মোর্চা সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
নারী দিবসের প্রথম সূচনা হয়, ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি প্রথম জাতীয় নারী দিবস পালন করার কথা ভাবেন। এর পরই আমেরিকানদের থেকে উৎসাহিত হয়ে জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে একটি দিন নারী দিবস হিসেবে পালনের কথা বলা হয়। যদিও এর জন্য কোনো তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি তখনও। এরপর ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্ৰেসে নারী অধিকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ক্লারা জেটকিন একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের কথা বলেন। সেখানেই উপস্থিত ১৭ জন নারী সদস্য তাকে সমর্থন জানান। তাদের মধ্যে ফিনল্যান্ডের প্রথম তিন সংসদ সদস্যও ছিলেন। মার্চেই দিনটির প্রাথমিক অনুষ্ঠান করা হয়। পরে ১৯১৩ সালে ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং জাতিসংঘ এই দিনটির বিশেষ থিম নির্বাচন করেন। প্রথম থিম ছিল ‘অতীতের উদযাপন ও ভবিষ্যতের জাতিসংঘ সাধারণ সভায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। তখন থেকেই প্রতি বছর একটি বিশেষ থিম বা ভাবনা নিয়ে পালন করা হয় দিনটি। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, নারী-পুরুষের সম-অধিকার নিশ্চিত করা, নারীর কাজের স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় নারী দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি পালন করেন বিভিন্ন সংগঠন। প্রতিবছরের মতো এ বছরও আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একটি প্রতিপাদ্য রয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য: ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। মূলত তথ্যপ্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নারীকে অনুপ্রেরণা জোগাতে এই বছরের নারী দিবসের স্লোগান নির্বাচন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস বিভিন্ন দেশে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হয়। যেমন- আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কম্বোডিয়া, কিউবা, জর্জিয়া, লাওস, মঙ্গোলিয়া, মন্টিনেগ্রো, রাশিয়া, উগান্ডা, ইউক্রেন এবং ভিয়েতনামে একটি সরকারি জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে স্বীকৃত। আলবেনিয়া, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া এবং উজবেকিস্তানের মতো কিছু দেশে, নারী দিবসকে মা দিবসের সাথে তুলনা করা হয়েছে। চীনে, মহিলা কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে অর্ধ-দিবসের ছুটি দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদেরকে অদূর ভবিষ্যতে একটি টেকসই পৃথিবী গড়তে হলে এখনই নারীর প্রতি বৈষম্য ও পুরুষের প্রতি পক্ষপাত দূর করে জেন্ডার সমতা নিশ্চিত করতে হবে এবং লিঙ্গভিত্তিক হয়রানি এবং নারী-বিদ্বেষ বিরোধী জনমত গঠনের প্রচেষ্টা। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব পরিসরে নারীরা যেন পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষ যেন স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে পারে, এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন কখনোই অর্জন করা সম্ভব হবে না। এজন্য আমাদের সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা বা বৈরি থাকলে চলবে না; একে অন্যের সহযোগী হতে হবে। পুরুষকে নারীর প্রতি সংবেদনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। যদিও নারীকে পুরুষের চেয়ে 'দুর্বল ও অধম' ভাবার একটি চর্চা আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রয়েছে; তবে এর বদল দরকার। এই বোধ যেদিন পুরুষের হবে, সমাজের হবে, সেদিন সমাজ বদলাবে- এর আগে নয়। এজন্য সবার আগে দরকার এ বিষয়ে সচেতনতা; হোক না তা নারী দিবসকে কেন্দ্র করেই! গর্জে উঠুক নারী বেঙ্গে দিক সর্ব অনিয়মের শিকল।