একবিংশ শতাব্দীতে সমাজ, লোকালয় ও প্রতিষ্ঠানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোও এর ঊর্ধ্বে না। দেশজুড়ে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করে অধিকাংশ নিম্নমধ্য বা দারিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে অনেকে পুরোপুরি বলা যায় আর্থ-সামাজিক পরিলক্ষিতায় সমস্যাযুক্ত। সর্বদা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ‘সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয় ও মানবতার সেবায়’ উদ্যমী হয়েছিলেন যুগযুগান্তর হাজারো মানুষ। ঠিক তেমনই যুগান্তরের কলিযুগে কুষ্টিয়ায় সুনাম অর্জন করেছিলেন এক ত্রাণকর্তা। যে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের সন্তান ও ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী। বলছিলাম ইঞ্জিনিয়ার আলিমুজ্জামান টুটুলের কথা। যুগযুগান্তরে আলোকিত মানুষ হয়ে মানবিক ও ব্যতিক্রমী কাজ করে বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই মানুষটির নাম। ইঞ্জিনিয়ার টুটুলের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ও বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে একশো ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই তুলে দিয়েছিলেন। গত বছরের (২৮ মার্চ) তিনি এসব তুলে দেন। এছাড়া জাতির পিতার ভালোবাসায় বিভিন্ন গাছের চারা বিতরণ করেন। এসব ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসার উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে। মুজিববর্ষে তিনি হাতে নিয়েছিলেন নানা কর্মসূচি। এসময় কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে বই ও প্রায় ১০ হাজার গাছের তারা বিতরণ করা হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার টুটুল বলেছিলেন, এটি তার পরিকল্পনা। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি কুইজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশ-বিদেশ সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেওয়া ও বিসিএসসহ চাকুরী পরীক্ষাগুলোতে উপযোগী হয়ে উঠতে কারেন্ট অ্যাফের্য়াস প্রদান করা। এছাড়া তিনি দুই হাজার জায়নামাজ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন যার মধ্যে প্রায় তিনশো বিতরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ জন ছাত্রকে বঙ্গবন্ধুর ১০০টি আত্মজীবনী উপহার দেন তিনি। তিনি বলেন শিক্ষার্থীরা এতে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হয়। তিনি ভালো কাজ করতে চাই, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই।
ইঞ্জিনিয়ার টুটুল গতবছর পবিত্র এই মাসে উপহার দিয়েছেন অনেককে। গত বছর এপ্রিলে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে পবিত্র রমজান মাসে বই বিতরণ, কুইজ প্রতিযোগিতা এবং রমজান মাস উপলক্ষে জায়নামাজ, তসবিহসহ নানা উপহারসামগ্রী নিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। প্রতিনিয়ত তিনি প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অফিসের সামনে থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বই তুলে দিতেন। অন্যদিকে কে কতটুকু পড়াশোনা করেছে তা জানতে আয়োজন করতেন কুইজ প্রতিযোগিতার। যারা ভালো করতেন তাদের তাৎক্ষণিক পুরস্কার হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক বিভিন্ন বই উপহার দিতেন। সেইসঙ্গে গল্প, উপন্যাস ও নানা জাতের বই বিতরণ করতেন বলে গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়। এসব ভালোলাগা থেকেই করতেন বলে অভিমত প্রদান করেন। তিনি তখন বলেন, পবিত্র মাসে সবার হাতে জায়নামাজ তসবিহ তুলে দিতে পেরে খুবই ভালো লেগেছে। এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে, তখন সাড়ে তিনশো জায়নামাজ ও ১৫’শ তসবিহ বিতরণ করা হয় বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
হজের টাকায় দুস্থদের জন্য ফ্রি মুদি দোকান করেছিলেন। করোনাকালের অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে করেছিলেন হজ পালন করবেন। প্রস্তুতি হিসেবে এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছু টাকাও জমিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ করে সারাবিশ^জুড়ে তাণ্ডব শুরু করে করোনা ভাইরাস। যার সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে প্রায় সব দেশের সরকার। এসময় বন্ধ ছিল গণপরিবহন, দোকান-পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তখন সাধারণ মানুষ চরম বিপাকে পড়ে যায়। বিশেষ করে দিনমুজুর শ্রেণীর সকলে চরম দুস্থতায় জীবন অতিবাহিত করেন। দিনে দুবেলা খাবার খেতে পারেনা। পরিবার থাকে না খেয়ে। তখন অসহায় সেই মানুষদের মুখে হাসি ফোটাতে এগিয়ে আসেন তিনি। হজের টাকা দিয়ে নিজ ইউনিয়নে দুস্থদের জন্য ফ্রি মুদি দোকানের ব্যবস্থা করেন। সেই ভ্রাম্যমাণ দোকানে চাল, ডাল, আটা, তেল, লবণ, সাবান, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মিষ্টি কুমড়া, পুঁইশাক, মরিচ, ঢেড়স, বাঁধাকপি, করলাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই ফ্রিতে নিতে পেরেছে দুস্থ ও দারিদ্যরা। ‘গ্রিন চাইল্ড’ ও ‘গ্রিন আর্কিটেক্ট’ নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে তিনি এই কার্যক্রম করেছিলেন। সেদিন আবেগ জড়িত কণ্ঠে নৌকার মাঝি মিলন বলেছিলেন, ‘ব্যাগে করে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মিষ্টি কুমড়া, পুঁইশাক, মরিচ, ভেন্ডি, বাঁধাকপিসহ অনেক কিছুই দিল কিন্তু কোনো টাকা নিল না।’
শিক্ষার্থীদের খাবারের ব্যবস্থা করেন ইঞ্জিনিয়ার টুটুল। তিনি তার পরিচিত কেউ টাকার অভাবে খাবার খেতে পারছে না জানালে তিনি নগত টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন। যে কাজগুলো এখনো বিদ্যমান। অনেক দুস্থ শিক্ষার্থীরা তার এই নগত অর্থ দিয়ে দিনে একবেলা খাবার খায়। তিনি এসব করে শিক্ষার্থীদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। এখনো শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে এসব গল্প শোনা যায়।
আধুনিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের রূপকার ইঞ্জিনিয়ার টুটুল। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরাল, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, ফুলে ফুলে ভরা লেক নির্মানে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে দেশ সেরা সমাজ সেবকের হিসেবে খুলনা বিভাগের সেরা সমাজ সেবক নির্বাচিত হয়ে নমিনেশন পান। তার আধুনিকায়নের একটি উদাহরণ দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব সম্পর্কে বলা যায়। এটি শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি স্মরনার্থে নির্মিত একটি উল্লেখযোগ্য ম্যুরাল বা প্রতিকৃতি দেয়াল চিত্র। ম্যুরালটি ২০১৮ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের প্রধান ফটকের সামনে নির্মাণ করা হয়। ২০২০ সালে এই ম্যুরালটির শব্দগুচ্ছ মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব গুগলে সার্চের শীর্ষস্থানে ছিলো। বর্তমানে এটি কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ অঞ্চলের অন্যতম পর্যটনস্থল। এটি বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং সারা বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি ম্যুরাল।
অনেক কিছু গুটিয়ে নিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার টুটুল। তিনি অনিন্দ্য সুন্দর বাহারি রাঙা ফুলের ক্যাম্পাসের কিছু স্বার্থলোভী মানুষের জন্য আজ অনেককিছুই গুছিয়ে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। যাদের অন্যায় অবিচার ও দুর্নীতি তিনি মেনে নিতে পারেননি বলে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ার টুটুলকে সরিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা তারা করেছিল। শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে মানবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি এই বিশ^বিদ্যালয় নিয়মিত আয়োজনগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। এতে ইঞ্জিনিয়ার টুটুলের কোন ক্ষতি হয়নি, তবে শিক্ষার্থীদের প্রতি মাসের বই ও শিক্ষামূলক আয়োজনগুলো বন্ধ থাকায় ক্ষতি হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বলে জানান তিনি।
দুস্থদের সারাজীবন পাশে থাকবে ইঞ্জি. টুটুল। ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিশেষ করে দুস্থদের সারাজীবন পাশে থাকবেন বলে জানিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার টুটুল। মানবিক হয়ে তিনি যেমন কাজ করে চলছিলেন। কিছু নকল স্বার্থলোভী মানুষ তার সম্মান ক্ষুণ্ন করতে মারিয়া হয়ে গিয়েছিল। তারা তার কাজে বাঁধা দিয়েছে। তবে দুস্থদের বিষয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে সুর মিলিয়ে বলেছেন ‘কেউ তার এই মানবিক কাজগুলো দাবায়ে রাখতে পারবে না’।
মানবিক সমাজে সবাই সেরা হয়ে স্থান করে নিতে পারে না। ইতিহাসে সেরা হওয়ার মতো মানুষ প্রতি বছর সৃষ্টি হয়না। ইতিহাসে আপন তাগিদে তাদের উদ্ভব হয়। হয়তো ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের ও কুষ্টিয়ার ইতিহাসে এমন একজন মানুষের প্রয়োজন অনুভব হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার আলিমুজ্জামান টুটুল তেমনি এক মানবিক মানুষ যার জন্য সৃষ্টি হয় ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা, দুস্থদের বন্ধু ও শিক্ষার্থীদের মুক্তির কান্ডারি আধুনিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় বিনির্মাণে নিয়োজিত আলিমুজ্জামান টুটুল। আজ থেকে বছরের পর বছর যখন ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির কথা লেখা হবে, তখন লেখক ও গবেষকদের পাতায় পাতায় বরাবর ফিরে আসবে মানবিক মানুষ ইঞ্জিনিয়ার আলিমুজ্জামান টুটুলের নামটি।